রপ্তানিমুখী বিভিন্ন শিল্পে বন্ডেড সুবিধা (রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক-কর পরিশোধ ব্যতিরেকে উপকরণ/কাঁচামাল এবং প্যাকিং সামগ্রী আমদানির সুবিধা) দেয় সরকার। কাস্টমস আইন ২০২৩ অনুযায়ী, পোশাক শিল্প বাদে বন্ডেড সুবিধায় উৎপাদিত পণ্য দেশের বাজারে বিক্রির সুযোগ নেই। তবে এই নিয়ম ভেঙে বন্ডেড সুবিধায় উৎপাদিত পণ্য দেশে বিক্রির আবদার জানিয়েছে চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআই। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা রয়েছে এবং আর কোনো প্রতিষ্ঠান তা উৎপাদন করে না, আমদানি করে মেটানো হয় চাহিদা। ফলে তাদের পণ্য দেশে বিক্রির সুযোগ দেওয়া হলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে নিজেদের একক আধিপত্য তৈরির জন্য নিয়ম ভাঙার আবদার করছে জেএমআই।
এদিকে, জেএমআই তাদের উৎপাদিত শতভাগ রপ্তানিমুখী পণ্য দেশের বাজারেও দেদার বিক্রি করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে জেএমআইর যে প্রভাব রয়েছে, তার জোরেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের রপ্তানিমুখী পণ্য অনৈতিকভাবে দেশের বাজারে বিক্রি করছে। এতে আমদানি করে আনা পণ্য অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। ক্ষতির মুখে পড়ছেন অনেক ব্যবসায়ী।
জেএমআই সম্প্রতি তাদের পণ্য দেশের বাজারে বিক্রির সুযোগ চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেয়। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে লেখা জেএমআইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুর রাজ্জাকের চিঠিতে বলা হয়, নিপ্রো জেএমআই কোম্পানি লিমিটেড শতভাগ রপ্তানিমুখী ব্লাড টিউবিং সেট (বিটিএস) উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যা জাপান, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত এবং জাপানি প্রযুক্তিতে পরিচালিত। এ কারখানায় উৎপাদিত বিটিএস এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এই পণ্যের ছোট বাজার রয়েছে। কিন্তু দেশে এই পণ্যের বন্ডেড কিংবা নন-বন্ডেড অন্য কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে আমদানির মাধ্যমে এই পণ্যের চাহিদা পূরণ হয়।
চিঠিতে বলা হয়, ‘বিগত বছরগুলোতে এসআরও নং ৯৯/আইন/৯৬/১৬৬২/ শুল্ক তারিখ ১৬.০৬.৯৬ এর মাধ্যমে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ঢাকা দক্ষিণ থেকে অনুমোদন নিয়ে আমরা দেশের কিডনি রোগীদের দুর্দশা লাঘবের সুযোগ পাই। ফলে দেশের আমদানির বিকল্প হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়। এসআরও নং ৯৯/আইন/৯৬/১৬৬২/ শুল্ক তারিখ ১৬.০৬.৯৬ রহিত করে শুধু পোশাক শিল্পের জন্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য এসআরও নং ২১৩ আইন/২০২৪/৬৫/কাস্টমস তারিখ ২৯/০৫/২৪/৬৫ কাস্টমস বিধি সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এতে বন্ডেড সুবিধায় উৎপাদিত পণ্য দেশের বাজারে বিক্রির সুযোগ বন্ধ হয়েছে।’
জেএমআইর চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘আমাদের উৎপাদিত বিটিএস একটি স্পর্শকাতর পণ্য। এই পণ্যের কোনো সাধারণ ব্যবহার নেই। এটি জটিল কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসে ব্যবহার হয়। ফলে এই পণ্যের অপব্যবহারের সুযোগ নেই।’
দেশে মৃত্যুপথযাত্রী কিডনি রোগীদের দুর্দশা লাঘব এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়ের বিষয়টি সদয় বিবেচনায় নিয়ে কিডনি ডায়ালাইসিসে ব্যবহৃত বিটিএস স্থানীয় বাজারে বিক্রির অনুমতি চাওয়া হয় চিঠিতে।
এ বিষয়ে বন্ড ও রপ্তানির দায়িত্বপ্রাপ্ত এনবিআর সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘জেএমআইর একটি আবেদন আমরা পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে বর্তমান আইনে এই সুবিধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
কিডনি বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের বাজারে দুটি কোম্পানির বিটিএস পাওয়া যায়। এর একটি ফ্রেসিনিয়াস এবং অপরটি জেএমআইর। ফ্রেসিনিয়াসের বিটিএসের দাম ৩০০ টাকা, জেএমআইর বিটিএসের দাম ২৮০ টাকা। এর আগে চীন থেকে একটি বিটিএস আনা হতো, সেটির দাম কম পড়ত এবং গরিব রোগীদের সুবিধা হতো; কিন্তু ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদন প্রক্রিয়া জটিল করায় এর আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশীয় বাজারে বন্ডেড সুবিধায় উৎপাদিত পণ্য বিক্রির অনুমোদন না থাকলেও বাজারে জেএমআইর বিটিএসই সবচেয়ে সহজলভ্য। তা ছাড়া জেএমআই প্রভাব বিস্তার করে হাসপাতালে এগুলো সরবরাহ করছে। ফলে আমদানিকৃত বিটিএস অনেকটা অবিক্রীত পড়ে থাকছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার্স অ্যান্ড এমএফআরএস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি আতিকুর রহমান বলেন, গরিব রোগীদের সক্ষমতার কথা বিবেচনা করে আগে বিভিন্ন দামের বিটিএস আমদানি ও বাজারজাত করা হতো। কিন্তু জেএমআই বাজার দখল করায় এখন জনতা ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান শুধু ফ্রেসিনিয়াস আমদানি করে। তিনি বলেন, ‘বন্ডেড সুবিধা নিয়ে জেএমআই উৎপাদিত পণ্য কীভাবে দেশের বাজারে বিক্রি করে সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।’
আগেও উঠেছিল অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ: সংশ্লিষ্টরা জানান, জেএমআই স্বাস্থ্য খাতে প্রভাবশালী হলেও তাদের অপকর্ম কম নয়। নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম সরবরাহে দুর্নীতির অভিযোগে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জেএমআই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও এমডি মো. আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন কমিশনের উপপরিচালক নুরুল হুদা দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ রাজ্জাকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে ওই মামলা করা হয়। ওইদিন দুপুরে কমিশনের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে একটি দল সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে আব্দুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করে। ওই মামলার অপর আসামিরা হলেন—কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) সাবেক উপপরিচালক ডা. জাকির হোসেন, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. শাহজাহান, ডেস্ক অফিসার জিয়াউল হক ও সাব্বির আহমেদ, স্টোর অফিসার কবির আহমেদ ও জ্যেষ্ঠ স্টোরকিপার মো. ইউসুফ ফকির।
এর আগে ওই বছরের এপ্রিলে করোনা মহামারির শুরুর দিকে জেএমআই এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের নামে সাধারণ ফেস মাস্ক দেয় বলে অভিযোগ ওঠে, যেখানে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এন-৯৫ মাস্ক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর তথ্য অনুযায়ী, এন-৯৫ মাস্ক হল এমন মাস্ক, যা বাতাসে ভেসে বেড়ানো সূক্ষ্ম কণাও আটকে দেয়। করোনার ওই ভয়াবহ সময়ে জেএমআই মাস্ক নিয়ে প্রতারণা করে দেশের মানুষকে বিশেষ করে স্বাস্থ্য কর্মীদের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। ওই সময়ে চিকিৎসকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেএমআইর সরবরাহকৃত ‘এন-৯৫’ এর মোড়কে দেওয়া সাধারণ মানের ফেস মাস্ক উঠিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।