Image description

এ এক মহাকাব্যিক প্রস্থান। একটি কফিনের পাশে পুরো বাংলাদেশ। বিরল রাষ্ট্রীয় সম্মান। কোটি জনতার হৃদয়নিংড়ানো শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষ বিদায়। দেশের আপামর জনতার কান্নাভেজা শ্রদ্ধায় চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তার শেষ বিদায়ের এই যাত্রায় শরিক হয়েছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সরকারের প্রতিনিধি, ৩২টি দেশের কূটনীতিক। 

দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে বেগম জিয়ার জানাজা হয়ে ওঠে স্মরণকালের বৃহৎ সমাগম। শুধু দেশ নয়, মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জানাজায় পরিণত হয় এটি। বিশ্বের কোনো নারী রাজনীতিকের প্রতি মানুষের এমন ভালোবাসার ঘটনাও বিরল। যে মানিক মিয়া এভিনিউতে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি লাখ লাখ মানুষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, তার জানাজায় অংশ নিয়েছেন সেখানেই ৪৪ বছর আগে তার স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি এমন এক শ্রদ্ধা জানানো হয়েছিল। জিয়ার জানাজাও হয়েছিল ঐতিহাসিক সমাগম। রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, জিয়ার জানাজার পর খালেদা জিয়ার জানাজাই দেশের ইতিহাসে বৃহৎ জানাজা। বেগম জিয়ার জানাজায় দেশের সব দল-মত ও পথের মানুষ মিলিত হয় মানিক মিয়া এভিনিউর মোহনায়। জানাজার ব্যাপ্তি জাতীয় সংসদের মাঠ, মানিক মিয়া এভিনিউ ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। রাস্তা, অলি-গলিতে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের স্রোত।  

পুরো রাজধানী পরিণত হয় শোকের নগরীতে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর ৪৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম আর ত্যাগের প্রতি মানুষের এই সম্মান রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন এক নজির তৈরি করেছে। ইতিহাসের বৃহত্তম জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয় বেগম খালেদা জিয়াকে।

এর আগে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের আইসিউতে ৩৭ দিন লড়াই করে ৩০শে ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোর ৬টায় না ফেরার দেশে চলে যান বেগম খালেদা জিয়া। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর খবর আলোর গতিতে ৫৬ হাজার বর্গমাইল ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়ায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রকাশ করেন শোক। ফেসবুকের পাতা ভরে শোকের বার্তা। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে পুরো দেশ। রাতে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মরদেহ এভারকেয়ারের হিমঘরে রাখা হয়। সেখান থেকে সকাল সোয়া ৯টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও কঠোর নিরাপত্তায় লাল-সবুজের পতাকার আদলের এম্বুলেন্সে করে আনা হয় গুলশানের বাসভবনে। স্বজনদের কান্নায় সেখানে এক শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়। মায়ের কফিনবাহী এম্বুলেন্সের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করেন বড় ছেলে তারেক রহমান। পাশে তার সহধর্মিণী জুবাইদা রহমান, কন্যা জাইমা রহমান এবং ভ্রাতৃবধূ সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি দোয়া-দরুদ পড়েন। 

স্বজনদের দেখার জন্য দীর্ঘ দুই ঘণ্টা খালেদা জিয়ার মরদেহবাহী এম্বুলেন্স রাখা হয় গুলশানের ১৯৬ নম্বর বাসভবনের সামনে। বেলা ১১টার দিকে চোখে জলে বাসভবন থেকে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে শেষ বিদায় দেন পরিবারের সদস্যরা। সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের যৌথ বাহিনীর কয়েক স্তরের কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে খালেদা জিয়ার কফিনবাহী এম্বুলেন্স রওনা হয় মানিক মিয়া এভিনিউমুখী। এম্বুলেন্সের সামনে সিটে বসেন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেএড এম জাহিদ হোসেন। কফিনবাহী এম্বুলেন্সের সঙ্গে বুলেট প্রুফ বিশেষ বাসে করে রওনা হন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, কন্যা জাইমা রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খালেদা জিয়ার কফিনবাহী এম্বুলেন্স পৌঁছে সংসদ ভবন এলাকায়। ততক্ষণে লোকারণ্য হয়ে পড়ে সংসদ ভবন, মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্রোত বাড়তে থাকে। আশপাশের কয়েক কিলোমিটার মূল সড়কের দুই পাশে মানুষ, ফুটওভার ব্রিজে মানুষ, রাস্তার পাশের বিভিন্ন ভবনের ছাদে মানুষ, অলিগলি, ফুটওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে জুড়ে শোকাহত মানুষ। কেউ স্লোগান দিচ্ছেন না, কেউ নির্দেশনা দিচ্ছেন না, তবু সবাই একইদিকে যাচ্ছে। এক নীরব শৃঙ্খলা। সুশৃঙ্খলা এসব মানুষের কারও হাতে শোকের কালো পতাকা, কারও বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করেন। কফিন পৌঁছানোর পর প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালীন যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, সেসব বক্তব্য জানাজাস্থলে প্রচার করা হয়। সংসদ ভবন এলাকার ভেতরে নারীদের জন্য আলাদা জানাজার জায়গার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে খালেদা জিয়ার পরিবারের নারী সদস্যরা অংশ নেন। বেলা ২টায় জানাজা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও মানুষের ভিড়ের কারণে মরদেহবাহী এম্বুলেন্স সংসদ ভবনের দক্ষিণপ্লাজায় আনতে এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বেলা তিনটার কিছু আগে জানাজার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

জানাজার আগে খালেদা জিয়ার সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এরপর তার বড় সন্তান ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে মায়ের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান এবং ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বুধবার বিকাল ৩টা ৩ মিনিটে শুরু হয় জানাজা। জানাজার নামাজ পড়ান জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি মোহাম্মদ আবদুল মালেক। জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বামপাশে দাঁড়ান বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ডানপাশে প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, এরপর জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিকুর রহমান এবং তারপরে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান দাঁড়ান। প্রধান উপদেষ্টার পাশাপাশি তার সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান, ফাওজুল কবির খান, আ ফ ম খালিদ হোসেন, আলী ইমাম মজুমদার, সি আর আবরার, কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, সাবেক নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, সাবেক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক প্রমুখ। জানাজা শেষে খালেদা জিয়ার কফিন বহন করে যারা এম্বুলেন্সে তুলেন তাদের মধ্যে মাওলানা মামুনুল হক ও মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারি, শায়খ আহমদুল্লাহকেও দেখা যায়।  

গুলশানের বাসভবন থেকে অশ্রুসিক্ত শেষ বিদায়: রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের হিমঘর থেকে বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মরদেহ নেয়া হয় গুলশানের বাসভবনে। সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে লাল-সবুজের পতাকার রংয়ে মোড়ানো এম্বুলেন্সে করে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মরদেহ আনা হয়। এম্বুলেন্স ঘিরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেন। খালেদা জিয়াকে শেষবারের মতো দেখানোর জন্য স্বজনরা আগে থেকেই গুলশানের ১৯৬ নম্বর বাসভবনে জড়ো হন। লাশবাহী এম্বুলেন্সটি প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনেকে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। কেউ কেউ দু’হাত তুলে মোনাজাত করেন। আবার কোরআন তেলাওয়াত করেন। স্বজন, আর নেতাকর্মীদের চোখের পানিতে গুলশানের ১৯৬ বাড়ির আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সিনিয়র নেতৃবৃন্দ।

সবাই যখন নীরবে চোখের পানি ফেলে দেশের আপসহীন নেত্রীকে বিদায় জানাচ্ছেন, ঠিক তখনই এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে। অশ্রুসিক্ত শেষ বিদায়ের মুহূর্তে মায়ের কফিনের এক পাশে বসে একাগ্রচিত্তে কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পুরো সময় জুড়ে তারেক রহমান ছিলেন, ধীর স্থির।  এ সময়  তারেক রহমানের পাশে মেয়ে জাইমা রহমান, স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানকে দেখা যায়। তারেক রহমানের এই নীরব প্রার্থনা অনেকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দলীয় নেতাকর্মী, আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা নীরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে।  বেলা ১১টা ৫ মিনিটে বাসভবন থেকে জানাজার উদ্দেশ্যে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পথে রওনা হয় লাশবাহী গাড়িটি। গাড়ির পেছনে ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ লেখা সম্বলিত বাসে ওঠেন তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, কন্যা জাইমা রহমানসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। শোক, ভালোবাসা আর স্মৃতির ভার বুকে নিয়ে এগিয়ে চলে শেষ যাত্রা এক অধ্যায়ের সমাপ্তি আর ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে।

কফিন বহন করলেন তিন আলেমেদ্বীন: বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কফিন বহন করেছেন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ, আলোচিত ইসলামী বক্তা মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মামুনুল হক। গতকাল রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে জানাজা শেষে বেগম জিয়ার স্বজনদের সঙ্গে এই তিন আলেম তার কফিন বহন করেন। 
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জানাজায় জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে। 

অংশগ্রহণকারী অন্য সদস্যরা হলেন- দলটির নায়েবে আমীর মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা আবদুল হালিম ও এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমীর মো. সেলিম উদ্দিন, ঢাকা মহানগর উত্তরের নায়েবে আমীর আবদুর রহমান মুসা, দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ঢাকা মহানগর উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি ডা. ফখরুদ্দিন মানিক, দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি কামাল হোসেন প্রমুখ।  

স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজা: বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজায় পরিণত হয়। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর জানাজায় মানুষের সমাগম হবে আগেই ধারণা করা হয়েছিল। জানাজার স্থল থেকে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার সড়ক, অলিগলিতে মানুষের ঢল ছড়িয়ে পড়ে। লোকসমাগম মানিক মিয়া এভিনিউ ছাপিয়ে দক্ষিণে ফার্মগেট, কাওরান বাজার পার হয়ে বাংলামোটর, শাহবাগ, ওদিকে ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর, কলাবাগান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। উত্তরে চীনমৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র পার হয়ে আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, পশ্চিমে আসাদগেট, লালমাটিয়া পার হয়ে কল্যাণপুর পর্যন্ত লোকারণ্য হয়ে পড়ে। পূর্বদিকে বিজয় সরণি ফ্লাইওভার, জাহাঙ্গীরগেট, তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত অবস্থান নেয় মানুষ। জায়গা না পেয়ে মেট্রোরেল স্টেশন, ফ্লাইওভার, আশপাশের বাসা-বাড়ির ছাদ, বারান্দা, অলিগলি থেকেও জানাজায় অংশ নিতে দেখা যায় অনেককে। কোথাও তিল ধারণের জায়গা ছিল না। সরজমিন দেখা যায়, খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে ভোর থেকেই বানের স্রোতের মতো মানুষ মানিক মিয়া এভিনিউমুখী আসতে থাকে। চারপাশের প্রধান সড়ক ও অলিগলি দিয়ে শোকের মিছিল শুরু হয়। জানাজার জন্য মানিক মিয়া এভিনিউর চারপাশের প্রধান সড়কে যান চলাচল আগে থেকেই বন্ধ করে দেয়ায় দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে মানুষ উপস্থিত হন।  বেলা ১২টার দিকেই মানিক মিয়া এভিনিউ সড়ক কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। পরে আশপাশের আসাদগেট, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর, ধানমণ্ডি ৩২, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, লালমাটিয়া,  সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল রোড, শিশুমেলা, আগারগাঁও সড়ক ও শ্যামলী পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়। গণভনের প্রধান ফটক থেকে শিশুমেলা হয়ে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে লাখ লাখ মানুষ বেগম জিয়ার জানাজায় অংশ নেয়। এ ছাড়া আড়ং থেকে মিনাবাজার হয়ে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর বাংলাদেশ চক্ষু হাসপাতাল পর্যন্ত সড়কে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে জানাজা নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। মানিক মিয়া এভিনিউ সড়কের শেষ মাথায় আড়ংয়ের পেছন পাশে লালমাটিয়ার অলিগলিতে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়ার জানাজা আদায় করেন। জানাজায় উপস্থিত শোকাহত লোকজন খালেদা জিয়ার ত্যাগ নিয়ে নানা মন্তব্য করেন। তারা বলেন, দেশের মানুষের অধিকারের জন্য গণতন্ত্রের জন্য জীবনে প্রায় সব রকম মানবিক কষ্টই ভোগ করে গেছেন বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে দুই শিশু সন্তানসহ বন্দি হন,  ১৯৭৫ সালে স্বামীর সঙ্গে গৃহবন্দি হন, ১৯৮১ সালে তরুণী বয়সে হারান স্বামী জিয়াউর রহমানকে,  এরপর দীর্ঘ ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ৩০  বছর দুই দু’টি স্বৈরাচারের নির্যাতন-নিপীড়ন, শেষ ১৮ বছর পরিবারহীন নিঃসঙ্গতা, গুলশান কার্যালয়ে গৃহবন্দি অবস্থায় ছোট সন্তানকে হারানোর বেদনা, বড় সন্তানকে পঙ্গু করে লন্ডনে নির্বাসনে পাঠানোর যন্ত্রণা, বিনা অপরাধে পরিত্যক্ত কারাগারে দুই বছর কাটানোর যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করেন। সহজ পথ এড়িয়ে তিনি স্বেচ্ছায় এই কঠিন পথ বেছে নিয়েছিলেন শুধু দেশবাসীর মুক্তির জন্য। 

স্মরণকালের অন্যতম বৃহৎ জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিকাল সাড়ে ৪টায় স্বামীর কবরের পূর্বপাশে তাকে সমাহিত করা হয়। এ সময় তার বড় ছেলে ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্য, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। দাফন শেষে খালেদা জিয়ার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তিন বাহিনীর সদস্যরা। এরপর বড় ছেলে তারেক রহমানও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর বুলেটপ্রুফ বাসে করে  তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা গুলশানের বাসভবনে ফিরেন। 

বিভিন্ন দেশে ও জেলায় গায়েবানা জানাজা: এদিকে ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় বেগম খালেদা জিয়ার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরাও সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর গায়েবানা জানাজা পড়েন। এদিকে চীনের শেনজেন শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদে বুধবার রাতে খালেদা জিয়ার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহত্তর চায়না বিএনপি’র আয়োজনে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীসহ দলমত নির্বিশেষে চীন প্রবাসী বাংলাদেশিরা এতে অংশগ্রহণ করে। ওদিকে বুধবার বাদ আসর মালদ্বীপের মালে শহরে খালেদা জিয়ার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা অংশ নেন।

জানাজায় অসুস্থ হয়ে একজনের মৃত্যু: সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নেয়া একজন হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বুধবার দুপুরে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশগ্রহণের পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের নাম মো. নীরব হোসেন (৫৬)। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ডালিমিয়া এলাকার মতিউর রহমানের ছেলে তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- ডিএমপি’র শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, নীরব নামের ওই ব্যক্তি বেগম খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রচুর ভিড়ে ও মানুষের চাপে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়। ওসি বলেন, আমরা চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছি- গরম ও হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।