নির্বাচনী সমঝোতার পথে অনেকটাই এগিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। গত বুধবার রাতে দুই দফা এবং গতকাল বৃহস্পতিবার এক দফা বৈঠক হয়েছে দুই দলের। দলগুলোর সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
তবে এনসিপিরই কয়েকজন নেতা জামায়াতের সঙ্গে জোট করার বিরোধী। এর মধ্যে রয়েছেন সম্প্রতি পদত্যাগ করা দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও তাদের সমর্থকরা। তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করার পক্ষে।
এদিকে জামায়াত ও এনসিপির আলোচনার মধ্যেই টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে আট দলে। প্রত্যাশিত সংখ্যক আসন না পেয়ে ক্ষোভ জানাচ্ছে জামায়াতের মিত্র চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন এবং মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। এ দুটি দলের প্রস্তাব, জামায়াত ১৩৫ আসনে, এনসিপির জোট ৩০ আসনে এবং বাকি সাত দল ১৩৫ আসনে নির্বাচন করবে।
দলগুলোর সূত্রের খবর, জামায়াত একাই দুই শতাধিক আসনে নির্বাচন করতে চায়। এনসিপি ও এবি পার্টিকে ৩০ আসন ছাড়তে চায়। বাকি আসন ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, জাগপা ও বিডিপির মধ্যে বণ্টন করতে চায়।
এনসিপির সঙ্গে এবি পার্টির গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট ৫০ আসন চায়। তবে এতেও টানাপোড়েন রয়েছে। এবি পার্টি একা ১৫ আসনে নির্বাচন করতে চায়। আবার এনসিপি এই দলটিকে এত আসন ছাড়তে চায় না বলে দলটির সূত্র জানিয়েছে।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব সমকালকে বলেছেন, আলোচনা চলছে। জোট হলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
জামায়াত ও এনসিপি সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, বুধবার সন্ধ্যায় জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের সঙ্গে বৈঠক করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। পরে রাজধানীর বাংলামটরে এনসিপির কার্যালয়ে দলের নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতা অনুমোদন করা হয়। এরপর রাতে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বাসায় বৈঠক করেন নাহিদ ইসলাম, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনসহ কয়েকজন নেতা।
এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মিলে গত মাসে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট করেছিল। জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু করায় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন জোট থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সরে গেছে। তবে এনসিপি ও এবি পার্টি যৌথভাবে আসন বণ্টনের আলোচনা চালাচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে। দুই দল একসঙ্গে মিলে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা করছে। আজকালের মধ্যে তা জামায়াতকে দেওয়ার কথা রয়েছে। এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ভূঁইয়া ফুয়াদ সমকালকে বলেছেন, আগে নিজেদের প্রার্থীদের তালিকা করা হচ্ছে। পরে আসন বণ্টন করা হবে।
সাবেক উপদেষ্টার সমর্থকরা ক্ষুব্ধ
জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে জোটের সম্ভাবনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সমর্থকরা। মাহফুজ ও আসিফ সরকার থেকে ১৫ দিন আগে পদত্যাগ করলেও কোনো দলে যোগ দেননি। তারা এনসিপিতে যোগ দেবেন কিনা– তাও নিশ্চিত নয়। আসিফ ঢাকা-১০ আসন থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। মাহফুজ নীরব রয়েছেন।
জামায়াতের সঙ্গে জোটের সম্ভাবনার পর আসিফ মাহমুদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা আবদুল কাদের এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদ ফেসবুকে ক্ষোভ জানান। তারা জামায়াতের সঙ্গে জোটের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিএনপির সঙ্গে জোট করার দাবি জানিয়ে এনসিপি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব মীর আরশাদুল হক।
এনসিপি সূত্র জানিয়েছে, দুই উপদেষ্টা এবং তাদের সমর্থকরা বিএনপির সঙ্গে জোট চান। তবে প্রত্যাশিত আসন না ছাড়ায় বিএনপির সঙ্গে যাচ্ছে না এনসিপির নেতৃত্ব। বিএনপি গত মাসে সাত-আটটি আসন ছাড়ার প্রস্তাব করলেও শেষ সময়ে এসে চারটি দিতে চেয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ এনসিপি নেতারা জামায়াতের সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু করেছেন। দুই দলের সরাসরি জোট, নাকি পর্দার আড়ালে আসন সমঝোতা হবে– তা আলোচনায় ঠিক হবে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
চরমোনাই ও মামুনুলের ক্ষোভ
১৫০ আসন চেয়েছিল ইসলামী আন্দোলন। পরে দলটি ১২০ আসন চায়। সবশেষ অবস্থান হলো ১০০ আসন ছাড়তে হবে। মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত ৫০ আসন চেয়েছিল। পরে দলটি ৩৫ আসন চায়। এনসিপি জোটে এলে দলটি অন্তত ২২টি আসন চায়। তবে জামায়াত ১০-১২টির বেশি ছাড়তে রাজি নয়। চরমোনাই পীরের দলকে ৩০ থেকে ৩৫টি আসন ছাড়তে চায়। বাকি পাঁচ দলকে সর্বোচ্চ ১৫টি আসন ছাড়তে চায়।
এতে ক্ষুব্ধ ইসলামী আন্দোলন এবং বাংলাদেশ খেলাফত। গতকাল গুঞ্জন ছড়ায়, দল দুটি জোট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ খেলাফতের যুগ্ম সচিব আতাউল্লাহ আমিন সমকালকে বলেছেন, এই গুঞ্জনের সত্যতা নেই। আসন বণ্টনের আলোচনা চলমান।
দলগুলোর সূত্র জানায়, আগামী রোববার আট দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক আহ্বান করে বাকিদের আমন্ত্রণ জানায় জামায়াত। তবে ইসলামী আন্দোলন এবং বাংলাদেশ খেলাফত জানায়, আসন বণ্টনের সুরাহা ছাড়া তারা বৈঠকে যোগ দেবে না। শরিফ ওসমান হাদি হত্যার বিচার ও সবার জন্য সমান সুযোগসহ তিন দাবিতে আগামী ৩ জানুয়ারি ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে জামায়াত। এতে সব দলের থাকার কথা ছিল। গতকাল ইসলামী আন্দোলন জানিয়েছে, অনুরূপ তিন দাবিতে ৯ জানুয়ারি তারা সমাবেশ করবে।
দলটির এক নেতা সমকালকে বলেছেন, এনসিপি জোটে আসার পর জামায়াত অন্যদের ভাগের আসন কমাচ্ছে। নিজের ভাগ থেকে ছাড়ছে না। তবে জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতাদের ভাষ্য, এই দাবি সঠিক নয়। একজন জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেছেন, জামায়াতের সিদ্ধান্ত ছিল রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনের সব ক’টিতে জামায়াত প্রার্থী দেবে। এই বিভাগে জোট হবে না। কিন্তু এনসিপি আসার পর জামায়াত নিজে জয়ী হওয়ার মতো রংপুর বিভাগের কয়েকটি আসন ছেড়ে দিচ্ছে।
আট দলের সমন্বয়ক এবং জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেছেন, আসন বণ্টনের আলোচনা চলমান। দু-একদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। সংস্কারের পক্ষে থাকা সব দল একসঙ্গে মিলে নির্বাচন করবে। কেউ জোট ছাড়বে– এমন খবর নেই।