Image description
 

রোমান আহমেদ ও মোসাম্মত মৌসুমি ইসলাম স্বামী-স্ত্রী। তাঁদের বাড়ির খোঁজে আমরা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরছিলাম।

রোমানের বাবার নাম গোলাপ মিয়া, মায়ের নাম খাদিজা বেগম। ঠিকানা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের সাদেকপুর গ্রাম। ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন তথ্যে রোমানের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে এটাই লেখা। তাঁদের তথ্য, সম্প্রতি রোমান ‘ডায়াবেটিসের কারণে মারা’ গেছেন।

অনেক খুঁজেও সাদেকপুর গ্রামের কারও কাছে রোমানের বাড়ির হদিস পাওয়া গেল না। শেষ চেষ্টা হিসেবে জন্মনিবন্ধনের তথ্য যাচাই করতে ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’-এর https://everify.bdris.gov.bd/ সিস্টেমে প্রবেশ করে রোমানের জন্মনিবন্ধন নম্বর ও জন্মতারিখ দিয়ে আসল ঠিকানা পাওয়া গেল, যা একই ইউনিয়নের বিরামপুর গ্রামে। এবার বিরামপুর গ্রামে গিয়ে সহজেই পাওয়া গেল রোমানের পরিবারকে। পাকা বাড়ির দরজায় গিয়ে ডাকতেই বেরিয়ে এলেন রোমানের মা খাদিজা বেগম। ঘটনাটি গত ১১ নভেম্বরের।

রোমান আহমেদকে কেন আমরা খুঁজছি, তা বলার আগে তাঁর সম্পর্কে একটু জানানো প্রয়োজন। ইউপির তথ্য অনুসারে, রোমানের বয়স ১৯ বছর, মৌসুমির ১৮। এই দম্পতির ১৯ সন্তান। ১৯তম সন্তান সাচ্চু জারিফের জন্ম হয় এ বছরের ১০ অক্টোবর। সন্তানসংখ্যা দেখে আপনি বিস্মিত? তাহলে ধৈর্য ধরে আরেকটু পড়ুন।

 

ইউপির তথ্য বলছে, সাচ্চু জারিফের মৃত্যু হয় জন্মের ৪০ দিন পর ৯ নভেম্বর। তার জন্মের দিন (১০ অক্টোবর, ২০২৫) ১৩ নম্বর সন্তান মিতু মনি এবং ১৮ নম্বর সন্তান মিলি মনিরও জন্ম হয়। মিতুর মৃত্যু হয় গত ৯ নভেম্বরে এবং মিলির মৃত্যু হয় গত ৩০ অক্টোবর।

তিনটি শিশুরই মৃত্যু ‘কার্ডিওজেনিক শকে (হৃদ্‌রোগ)’। তিন সন্তানের জন্মের আগের দিন মৃত্যু হয় বাবা রোমানের। আর দুই সন্তানের জন্মের দিন ১০ অক্টোবর মৃত্যু হয় মা মৌসুমির। এক সন্তানের জন্ম হয় তাঁর মৃত্যুর পর।

১৮ বছর বয়সী মায়ের ১৯ সন্তান, মায়ের মৃত্যুর ২০ দিন পর সন্তান জন্ম—এসব শুনে আপনার হয়তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়েছে। তবে জেনে রাখুন, এসব বাংলাদেশের সরকারি তথ্যভান্ডারের তথ্য এবং পুরোটাই ভুয়া। তথ্যভান্ডারটি রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের।

মানুষের জন্ম-মৃত্যুর তথ্য নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে ইচ্ছেমতো শিশুদের জন্মের তথ্য দেখানো হচ্ছে। তারপর অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তাদের মৃত্যুর তথ্য দেখা হচ্ছে। কারণ, ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের লক্ষ্যপূরণের চাপ থাকে। পাশাপাশি লক্ষ্য পূরণ করলে পাওয়া যায় স্বীকৃতি। এ কারণে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। সেটার প্রমাণ ‘রোমান ও মৌসুমি দম্পতির’ ঘটনাটি।

ইউপির তথ্য অনুসারে, রোমানের বয়স ১৯ বছর, মৌসুমির ১৮। এই দম্পতির ১৯ সন্তান। ১৯তম সন্তান সাচ্চু জারিফের জন্ম হয় এ বছরের ১০ অক্টোবর। সন্তানসংখ্যা দেখে আপনি বিস্মিত? তাহলে ধৈর্য ধরে আরেকটু পড়ুন।

নিয়ম অনুসারে, অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য আবেদন করার পর আবেদনকারী সনদের জন্য ইউপির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা ইউপি সচিবের কাছে আসেন। এখানে ইউপি সচিব সহকারী নিবন্ধক আর ইউপি চেয়ারম্যান নিবন্ধক। ইউপি সচিব রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সিস্টেমে প্রবেশ করেন এবং আবেদনকারীর তথ্য যাচাইয়ের পর অনলাইনে নিবন্ধন ফি পাঠিয়ে (আবেদনকারীর দেওয়া টাকা) গ্রহণ করেন। তারপর নিবন্ধক বা চেয়ারম্যান তাঁর আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে নিবন্ধন করেন। চেয়ারম্যান অনুমোদন দেওয়ার পর ইউপি সচিব তাঁর আইডি থেকে জন্ম ও মৃত্যুসনদ প্রিন্ট করে আবেদনকারীকে দেন।

রোমান ইউপি থেকে সনদ নেওয়ার পর তাঁর জন্মনিবন্ধনের নম্বর ও জন্মতারিখ ব্যবহার করে তাঁর অজান্তে ইউপি কার্যালয় থেকে কাল্পনিক দম্পতি তৈরি করা হয়েছে এবং সেই কাল্পনিক দম্পতির শিশুদের ভুয়া জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করা হয়েছে। রোমানের ঠিকানায় শুধু গ্রামের নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

১১ নভেম্বর বেলা দেড়টায় রোমানের বাড়িতে যখন আমরা পৌঁছাই, তখন তাঁর মা খাদিজা বেগম দুপুরের খাবার রান্না করছিলেন। কিছুদিন আগে গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, হামলা ও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনায় তাঁদের দোষী করা হবে কি না, সেই আতঙ্কে তিনি আমাদের দেখে ভীত হয়ে পড়েন।

অবশ্য পরিচয় দিয়ে কথা বলে জানা গেল, তাঁর স্বামী গোলাপ মিয়া কুমিল্লায় বেকারির ব্যবসা করেন। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। রোমান দ্বিতীয়। বড় ছেলে রুবেল সৌদিপ্রবাসী। আর রোমান ঢাকায় দোকানে কাজ করেন। মেয়ে বিয়ে করেছেন। তাঁর দুই ছেলের কেউ বিয়ে করেননি।

  

অর্থাৎ রোমানের স্ত্রী হিসেবে যে মৌসুমির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি ভুয়া। তাঁর ছেলের জন্মনিবন্ধন করেছেন ইউপি কার্যালয়ে। ছেলের জন্মনিবন্ধন ব্যবহার করে ভুয়া আরও নিবন্ধন তৈরির বিষয়টি তাঁদের জানা নেই। কেন ‘শিশুদের বাবা’ হিসেবে রোমানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিও একটু বলা প্রয়োজন। ২০১৩ সালের পর জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্মনিবন্ধন করতে হলে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন লাগে। ফলে একটি ভুয়া শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে হলে বাস্তবে রয়েছে এমন কারও সনদের তথ্য প্রয়োজন হয়। ইউপি কার্যালয়ে সংরক্ষিত জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের ডেটাবেজে থাকা ব্যক্তিদের প্রকৃত তথ্য ব্যবহার করে এভাবে একাধিক ভুয়া নিবন্ধন তৈরি করা হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সাদেকপুর ও বুধল, কসবা উপজেলার কুটি এবং আশুগঞ্জ উপজেলার চরচারতলা ইউনিয়ন ঘুরে ভুয়া নিবন্ধনের তথ্য পাওয়া গেছে। শিশুদের ক্ষেত্রেই ভুয়া সনদের ঘটনা বেশি। এমন অনেক শিশুর নিবন্ধন করা হয়েছে, যারা আসলে জন্মই নেয়নি। কাগজে-কলমে তাদের জন্ম ও মৃত্যু দেখানো হয়েছে। শিশুদের বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ, জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করতে কোনো টাকা লাগে না। এরপর টাকা লাগে (৫ বছর পর্যন্ত ২৫ টাকা)। শিশুর জন্ম দেখিয়ে ৪৫ দিনের মধ্যেই তার মৃত্যু দেখিয়েছেন নিবন্ধকেরা, এতে ভুয়া নিবন্ধনের জন্য তাঁদের পকেটের টাকা খরচ করতে হয়নি। ইউপি সচিবেরা প্রথম আলোর কাছে বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। বলেছেন, শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয়, সারা দেশেই জালিয়াতির ঘটনা কম-বেশি ঘটছে।

২০১৩ সালের পর জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্মনিবন্ধন করতে হলে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন লাগে। ফলে একটি ভুয়া শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে হলে বাস্তবে রয়েছে এমন কারও সনদের তথ্য প্রয়োজন হয়। ইউপি কার্যালয়ে সংরক্ষিত জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের ডেটাবেজে থাকা ব্যক্তিদের প্রকৃত তথ্য ব্যবহার করে এভাবে একাধিক ভুয়া নিবন্ধন তৈরি করা হয়েছে।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের জালিয়াতির অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানের জন্য একটি জেলা হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ, ৭-৮ মাস আগেও জেলাটি জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের দিক দিয়ে ৫৬ নম্বরে ছিল। এ বছরের অক্টোবর মাসে জেলাটি ৫০ ধাপ এগিয়ে ৫ নম্বরে চলে এসেছে। দায়িত্বশীল সূত্রের সহযোগিতায় দীর্ঘ সময় ধরে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের সিস্টেম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিনটি উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ২৫৮টি জন্মনিবন্ধন, ২৫১টি মৃত্যুনিবন্ধনসহ মোট ৫০৯টি তথ্য সংগ্রহ করে প্রথম আলো। ভুয়া নিবন্ধন বোঝার উপায় সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক। সেসব নিবন্ধন ধরে গত ১০ থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫টি ইউনিয়ন ঘুরে তথ্য যাচাই করা হয়েছে। ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টিতেই ভয়াবহ জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ভুয়া নাম ঢোকানোর ফলে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্যভান্ডার ও সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভুয়া নাম ঢুকে যাওয়ার মানে হচ্ছে ‘সিস্টেম’ দূষিত হওয়া, বাড়তি জনসংখ্যার তথ্য ঢুকে সরকারের পরিকল্পনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। তিনি বলেন, ভুয়া নাম ও তথ্য ঢোকানোর সুযোগ থাকলে রোহিঙ্গাদের নামও ঢুকতে পারে। অপরাধীরা ভুয়া নিবন্ধনগুলো ব্যবহার করার সুযোগ নিতে পারে।

তবে মো. নজরুল ইসলাম নাগরিকদের সচেতন থাকার বিষয়েও জোর দেন। তিনি বলেন, জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হলেও তা কার্যকরে আইনের প্রয়োগ নেই। স্কুলে ভর্তির আগে শিশুদের জন্মনিবন্ধন আর সম্পদ ভাগাভাগির প্রয়োজন ছাড়া নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে মৃত্যুনিবন্ধন করতে দেখা যায় না।