দেশের সাধারণ নাগরিককে হাতে পাসপোর্ট পেতে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি। অথচ অনায়াসে পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। পাসপোর্ট অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এসব পাসপোর্ট ব্যবহার করে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। সেখানে জড়িয়ে পড়ছে অবৈধ কর্মকা-ের সঙ্গে। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœœ হচ্ছে। পাসপোর্টের মানও কমছে। অথচ রোহিঙ্গাদের নামে পাসপোর্ট ইস্যু প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। রোহিঙ্গাদের নামে পাসপোর্ট ইস্যুতে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী চক্র। পাসপোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই পৃষ্ঠপোষকতা দেন এ চক্রটিকে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয় দায়সারা গোছের। প্রতিবেদনে চক্রের মূল হোতাদের খুব একটা ঘাটানো হয় না। ‘ধরা পড়া’ অধঃস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও নেয়া হয় না কঠোর কোনো আইনি ব্যবস্থা। ফলে দিনকে দিন বেড়ে চলেছে রোহিঙ্গাদের নামে পাসপোর্ট ইস্যুর ঘটনা। এ পর্যন্ত কত সংখ্যক রোহিঙ্গার নামে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে তার হিসাব নেই। মাঝে মধ্যেই আলোতে আসছে দু’-একটি ঘটনা। ধরা পড়লেও খোদ পাসপোর্ট অধিদফতরের পক্ষ থেকে চেষ্টা চলে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার।
চাপাপড়া এমনই একটি হচ্ছে সম্প্রতি ১১৮ রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট ইস্যুর ঘটনা। প্রতিবেদকের নিজস্ব অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, কতটা কৌশলে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলেছে এ বিষয়টি। সম্প্রতি গুরুতর অপরাধের ‘লঘু’ শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে শতাধিক রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট প্রদানের ঘটনা। ঘটনার শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হলেও দায়সারা গোছের তদন্তে প্রান্তিক পর্যায়ের দুই কর্মকর্তাকে দেয়া হয় দায়মুক্তি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া অন্তত ১১৮ রোহিঙ্গাকে ‘বাংলাদেশি নাগরিক’ হিসেবে পাসপোর্ট দেয় ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার সহযোগিতায় তাদের নামে পাসপোর্ট ইস্যু হয়। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব তদন্তেই উঠে এসেছে এসব তথ্য। তবে গুরুতর এ অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে নামকাওয়াস্তে ‘শাস্তি’ প্রদানের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে দায়মুক্তি। গুরুতর অপরাধের ‘লঘুদ-’ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে।
এর মধ্যে গত ৮ অক্টোবর ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর জারি করা হয় একটি প্রজ্ঞাপন। তাতে দেখা যায়, পাসপোর্টের উপ-সহকারী পরিচালক নিগার সুলতানাকে এক বছরের জন্য বার্ষিক বর্ধিত বেতন স্থগিত করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনটির তথ্য মতে, রাজধানীর উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে ইস্যুকৃত ১১৮টি পাসপোর্টে উল্লিখিত ‘স্থায়ী ঠিকানা’ সঠিক নয়। গোয়েন্দা সংস্থার ‘অধিকতর তদন্ত’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাসপোর্টধারী ব্যক্তিরা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ভুক্ত। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ভুক্তদের পাসপোর্ট আবেদনপত্র গ্রহণ, অ্যানরোলমেন্টকারী শনাক্ত করে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়। সরেজমিন তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপসহকারী পরিচালক নিগার সুলতানা ৩৮টি ইআইডির অনুকূলে ইস্যুকৃত পাসপোর্টের আবেদন সিল-স্বাক্ষর দিয়ে গ্রহণ করেন। ইআইডিগুলো হচ্ছেÑ ৪০১১-১৯১৪৩১, ২০৫৮৯০, ২০৯৭৯৩, ২০৯৭৯৭, ২১০০৮১, ২১৪৬৩২, ২১৪৬৩৫, ২১৪৬৩৬, ২১৬০৬০, ২১৭১০০, ২১৭১০১, ২১৭১০২, ২২০৩৩০, ২২২৭১২, ২২৬৫৭৮, ২২০৩৩১, ২২৯৬৭৯, ২২৯৬৮০, ২২৯৬৮১, ২২৯৭৮৫, ২২৯৭৮৬, ২৩০৩৬২, ২৪০০২১, ২৪১২০৪, ২৩৮৩২৯, ২৪১২০৩, ২৩৮০১৪, ২৪২৯২৪, ২৪২৯২৫, ২৪৩০৪৭, ২৪৪৪২৯, ২৪৪৫৬১, ২৪৪৪২৫ এবং ২৪৪৫৫৯।
জানা গেছে, পাসপোর্ট অধিদফতরের ভেতর এবং বাইরে সক্রিয় একটি দালালচক্র বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ‘বাংলাদেশি নাগরিক’ হিসেবে পাসপোর্টগুলো ইস্যু করে। বিনিময়ে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এ টাকা পাসপোর্টের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। তবে এ বিষয়টি এড়িয়ে নিগার সুলতানার অপরাধ গৌণ করা হয় প্রজ্ঞাপনে। তাতে বলা হয়, আবেদনপত্রের সঙ্গে দাখিলকৃত দলিলাদি সঠিকভাবে যাচাই-বাছাইপূর্বক আবেদনকারীর সঙ্গে কথা বলে তার প্রাক-পরিচয় নিশ্চিত হয়ে আবেদন জমা গ্রহণ একজন কর্মকর্তার দায়িত্ব। তিনি (নিগার সুলতানা) এরকম দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ নিযুক্তিতে থেকেও দাখিলকৃত দলিলাদি সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করেননি। আবেদনকারীর সঙ্গে তার প্রাক-পরিচয় নিশ্চিত হননি। আবেদনপত্র গ্রহণে তার দায়িত্বহীনতার ফলে আবেদনকারীরা পাসপোর্ট পেয়ে যান। এতদ-বিষয়ে তদন্তের জন্য নিয়োগকৃত তদন্ত কর্মকর্তার দাখিলকৃত প্রতিবেদন তার (নিগার সুলতানা) সংশ্লিষ্টতার বিষয় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
তার বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ এর ৩(খ) বিধিমতে ০৪-০৮-২০২৫ তারিখের ৫৮.০১.০০০০.১০১.৪৪.০৪০.২৩.২৬৯৮ নম্বর স্মারকমূলে বিভাগীয় মামলা (নং-২৮২০২৫) রুজু করে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী প্রেরণ করা হয়। অভিযুক্ত কর্মকর্তা গত ১৭-০৮-২০২৫ তারিখে উক্ত অভিযোগনামায় বর্ণিত অভিযোগের বিষযে লিখিত জবাব প্রদান করেন এবং ব্যক্তিগত শুনানি প্রার্থনা করেন। অভিযুক্তের আবেদনের প্রেক্ষিতে তার লিখিত জবাব বিবেচনায় গত ০৪-০৯-২০২৫ তারিখে ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহণ করা হয়। ব্যক্তিগত শুনানিতে তার বক্তব্য, দাখিলকৃত জবাব, নথিপত্র পর্যালোচনা এবং তার চাকরিকাল ইত্যাদি পর্যালোচনায় গুরুত্ব বিবেচনায় ‘লঘুদ-’ আরোপ যুক্তিযুক্ত মর্মে প্রতীয়মান হয়। সেহেতু উপ-সহকারী পরিচালক (ভিসাসেবা, হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা) নিগার সুলতানা (বর্তমানে পার্সোনালাইজেশন কমপ্লেক্স, উত্তরা, ঢাকা) এর বিরুদ্ধে আনীত সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে অভিযোগের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিক সব বিষয় বিবেচনায় একই বিধিমালার ৪(২) এর (খ) বিধি মোতাবেক এক বছরের জন্য ‘বার্ষিক বর্ধিত বেতন স্থগিত’ লঘুদ- প্রদান করা হলো।
একই তারিখে আরেকটি ‘অফিস আদেশ’ জারি করে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর। প্রায় একই ধরনের অভিযোগ ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত’ হয়েছে-মর্মে উল্লেখ করে তৎকালীন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, উত্তরার সুপারিনটেনডেন্ট মো. আবুল হোসেনকে করা হয় ‘তিরস্কার’। শুধু তাই নয়Ñ তাকে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস থেকে নরসিংদী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সংযুক্ত করা হয়। মো. আবুল হোসেন ১১৮টি পাসপোর্টের মধ্যে অন্তত ২৫টি পাসপোর্ট পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) রিপোর্ট আবেদনকারীদের বিপক্ষে আসা সত্ত্বেও সেটি রিভিউ না করে পাসপোর্ট ইস্যুর জন্য পাঠান।
পাসপোর্ট অধিদফতরের ‘অফিস আদেশ’ এ বলা হয়Ñ সাধারণত নতুন ই-পাসপোর্টের আবেদনপত্রের পুলিশ প্রতিবেদন বিপক্ষে আসার পর ম্যানুয়াল রিভিউকারী সঠিক তথ্য সংযোজন এবং সাপোর্টিং ডক্যুমেন্ট আপলোড দেয়ার জন্য বায়ো-অ্যানরোলমেন্ট মডিউলে পাঠান। বায়ো-অ্যানরোলমেন্ট মডিউল থেকে সঠিক ডকুমেন্ট অনুযায়ী তথ্য সংশোধন এবং সাপোর্টিং ডকুমেন্ট আপলোড করে সাব-টিম করা হয়। পরে কিছু আইডি সরাসরি এসবি/ডিএসবিতে চলে যায়। কিছু ইআইডি ম্যানুয়াল রিভিউতে আসে। মো. আবুল হোসেন পাসপোর্টের ঢাকার উত্তরা অফিসে কর্মরত থাকাকালে ২৫টি ইআইডির অনুকূলে ইস্যুকৃত পাসপোর্টের ম্যানুয়াল রিভিউ সম্পন্ন করেন। ইআইডিগুলো হচ্ছে, ৪০১১-১৪৩১১৩, ২০৯৩৪০, ২০৯৭৯৩, ২০৯৭৯৭, ২১০০৮১, ২১৪৬৩২, ২১৪৬৩৫, ২২৬৫৭৮, ২২০৩৩১, ২২৯৬৭৯, ২২৯৭৮৩, ২২৯৭৮৫, ২২৯৮৯১, ২৩৩০১৫, ২৩৩০১৬, ২৩৭৩৭৯, ২৪০০২১, ২৪১২০১, ২৪১২০২, ২৪১২০৪, ২৪২৭৫৩, ২৪৪৪২৯, ২৪৪৫৬১ এবং ২৪৪৫৫৯।
মো. আবুল হোসেন সম্পর্কিত অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়, আবুল হোসেনের এ ধরনের অপরাধ ‘স্বভাবসুলভ’। অর্থাৎÑ তিনি আগে ২০২১ সালে একবার একই ধরনের অপরাধ করেন। আবুল হোসেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের মাধ্যমে প্রেষণে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে নিয়োগ পান। পাসপোর্ট ও ভিসা শাখা, বাংলাদেশ দূতাবাস, কুয়েতে কর্মরত থাকাকালে তার বিরুদ্ধে একবার পাসপোর্ট সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তখন তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে রহস্যজনকভাবে তাকে ‘কঠোরভাবে সতর্কতাসহ কঠোর ভর্ৎসনা’ করা হয়। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করেছেন মর্মে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে পুনরাং ভর্ৎসনা করা হয়। কোনো ফৌজদারি ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। জানা গেছে, ‘ব্যক্তিগত শুনানি’-এর আড়ালে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে দ্বিতীয়বারও দায়মুক্তি লাভ করেন। এর আগে তার ‘ব্যক্তিগত শুনানি’ নেয়া হয়। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের গত ৮ অক্টোবর দেয়া অফিস আদেশে দায়মুক্তি দিয়ে বলা হয়, যেহেতু মো. আবুল হোসেন, সুপারিনটেনডেন্ট, বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, সিলেট (সংযুক্ত : আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, নরসিংদী) বিরুদ্ধে আনীত সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদারচরণ’-এর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে অভিযোগের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিক সব বিষয় বিচেনায় একই বিধিমালার ৪(২) এর (ক) বিধি মোতাবেক ‘তিরস্কার’ সূচক লঘুদ- দেয়া হলো।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা প্রতি দুই থেকে তিন লাখ টাকা করে নিয়ে থাকে। এটির একটি আন-অফিসিয়ালি রেট। আবেদনপত্র গ্রহণ থেকে শুরু করে পাসপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা খরচ করছেন দুই থেকে তিন লাখ টাকা। উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস জমা হয়। উত্তরা আঞ্চলিক অফিসের দায়িত্বে রয়েছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মো. নূরুল হুদা। নিয়ম অনুযায়ী সশরীরে হাজির হয়ে তার অফিসেই পাসপোর্টের আবেদন দেন রোহিঙ্গারা।
তার যে সাক্ষাৎকার নেবেন, তার দায়িত্ব ন্যাশনালিটি যাচাই করা। সে ক্ষেত্রে ‘প্যাকেজ ডিল’ থাকলে রোহিঙ্গার ন্যাশনালিটি যাচাই করা হয় না। রোহিঙ্গা আবেদনকারীর ভাষা, জন্মসনদ, চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট এবং বর্তমান ঠিকানা দিতে হয়। কোনো রোহিঙ্গা নাগরিক এসব তথ্য সঠিকভাবে দিতে পারেন না। বিষয়টি ধরা পড়ার পর নিয়ম অনুযায়ী রোহিঙ্গাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া সংশ্লিষ্ট অফিস প্রধানের দায়িত্ব। কিন্তু ‘প্যাকেজ ডিল’-এর আওতায় আসার কারণে তিনি সেটি করেন না। আবেদনকারীর রেকর্ডপত্র সঠিক কি-না সেটি বোঝা যায় সার্ভারে যাওয়ার পর। রেকর্ডপত্র ভুয়া হলে সার্ভারেও পাসপোর্ট আটকে যেতে পারে। কিন্তু ‘প্যাকেজ ডিল’ হওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের আবেদনগুলো আটকানো হয় না। সার্ভারে দায়িত্বপালনকারী ৩০ কর্মকর্তা যে যার সঙ্গে সিন্ডিকেটভুক্ত রয়েছেন তার আবেদনগুলো আটকাচ্ছেন না। অতি দ্রুততার সঙ্গে যেসব পাসপোর্ট ইস্যু হচ্ছে সেগুলো ফরেনসিক করলেই পুরো দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসে।
সেটি পরে দিয়াবাড়িতে অবস্থিত পাসপোর্টের মূল সার্ভারে এটি যাচাই-বাছাই হয়। সেখানকার দুর্নীতিবাজ পাসপোর্ট কর্মকর্তা-কর্মকর্তারা জড়িত রোহিঙ্গাপাসপোর্ট অফিস ইস্যুর ক্ষেত্রে। পাসপোর্টের আবেদন যেখানেই জমা দেয়া হোক। পাসপোর্টের সার্ভারের দায়িত্বে রয়েছেন পরিচালক মো. সাইদুর রহমান। তার অধীনে প্রথম শ্রেণির অন্তত ১০ জন কর্মকর্তা। তাদের অধীনস্ত রয়েছেন ৩০ জন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। তাদের দায়িত্ব রেকর্ডপত্র-কাগজপত্র চূড়ান্ত যাচাই করবেন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে পাসপোর্টের নিজস্ব তদন্তে তাদের কোনোভাবেই দায়ী করা হয়নি। সাইদুর রহমান সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে আ.লীগ শাসনামলে দাপট দেখিয়ে আসছেন। এ দাপটের কারণেই রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ইস্যুতে তার ভূমিকার প্রসঙ্গই টানা হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মূল সার্ভারের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যু চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ছাড়া প্রধান কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাও প্রান্তিক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে রোহিঙ্গা পাসপোর্ট প্রার্থী সংগ্রহ করেন।
রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যুর ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত নিগার সুলতানা পরিচালক (পাসপোর্ট, ভিসা ও পরিদর্শন) নাদিরা আক্তাররের ঘনিষ্ঠ। অভিযোগ রয়েছে, নাদিরার গাড়ির তেল খরচ, ড্রাইভারের খরচ, বাজার খরচ নিগার সুলতানা বহন করেন। পাসপোর্টের উত্তরা আঞ্চলিক অফিসে তিনি ২০ বছর ধরে চাকরি করেন। নানা ক্যারিকেচার করে নাদিরা এবং নিগার সুলতানা সবসময় একই অফিসে পোস্টিং নিতেন। বিগত সরকার আমলে তারা ‘আওয়ামী ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে নির্বিঘেœ চাকরি করার পর গত ৫ আগস্টের পর নাদিরা হয়ে ওঠেন ‘বিএনপিঘনিষ্ঠ’ কর্মকর্তা। অন্যদিকে, আবুল হোসেন চাকরি করছেন জামায়াত রাজনৈতিক আদর্শের কর্মকর্তা অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ টি এম আবু আসাদের ছত্রছায়ায়। এ কারণে আবুল হোসেনের বিরুদ্ধেও কার্যকর শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যুর অভিযোগ সম্পর্কে কথা বলতে আবুল হোসেনকে কল করা হয়। ফোনটি রিসিভ করা হলেও অপর প্রান্ত থেকে ‘এটি আবুল হোসেনের নম্বর নয়’ মর্মে দাবি করা হয়।