Image description
তারেক রহমানের সামনে যত চ্যালেঞ্জ

প্রায় দেড় যুগ লন্ডনে নির্বাসিত জীবন শেষে ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘদিনের অপেক্ষা, জল্পনাকল্পনা ও নানা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তার এ প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে নতুন গতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে তার সামনে নানা চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে এবং ভোটে জয়ী হলে সরকার গঠনের পরও বিএনপিকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে ক১রছেন। তাদের মতে, মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় কোন্দল নিরসন এবং নিরাপত্তা বজায় রাখার পাশাপাশি অন্যান্য দলের সঙ্গে বিএনপির সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। এছাড়া মব ভায়োলেন্স ও পতিত আওয়ামী লীগসহ একটি গোষ্ঠীর নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র মোকাবিলাও বড় চ্যালেঞ্জ হয়েছে দাঁড়াতে পারে। আবার জনগণের ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে মেরামত করে শক্তিশালী করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে আরও বড় চ্যালেঞ্জ।

রোববার রাজধানীতে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, তারেক রহমানের জন্য এটি একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় সময়। কারণ, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে গভীর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এ মুহূর্তে একধরনের ধ্বংসপ্রায় অবস্থার মধ্যে আছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এও আশঙ্কা করছেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পতিত ফ্যাসিবাদ ও বিএনপিবিরোধী মতের অপতৎপরতা আরও জোরালো হতে পারে; যা ইতোমধ্যে শুরুও হয়েছে। তারেক রহমানকে টার্গেট করে অপপ্রচার, বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। তাদের মতে, দেশে ফেরার পর এসব অপতৎপরতা আরও সংগঠিত ও আগ্রাসী হতে পারে। ফলে দল হিসাবে বিএনপিকে আগেভাগেই ডিজিটাল পর্যায়েও সজাগ ও প্রতিরোধমূলক অবস্থান নিতে হবে। এছাড়া তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর বিএনপির অভ্যন্তরেও নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। কিছু নেতাকর্মীর মধ্যে প্রভাববিস্তার, দৌড়ঝাঁপ ও সিন্ডিকেট তৈরির প্রবণতা মাথাচাড়া দিতে পারে। এগুলো সামাল দিতে হবে তারেক রহমানকে। রোববার রাজধানীতে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, আগামী দিনে সরকার গঠনকারী দলের জন্য সময়টা হবে বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময়। বিএনপির কাছ থেকে আরও বেশি সহ্যশক্তি, আরও বেশি সমালোচনা গ্রহণের মানসিকতা দেখতে পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যে দল ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে, তাদের নেতৃত্ব, আচরণ ও বিনয় আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

তারেক রহমানও বিভিন্ন সভায় নিজেই বলেছেন, সামনে অনেক কাজ, অনেক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। দেশের মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। তারা বিএনপিকে আস্থায় রাখতে চায়। আমাদের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। নাহলে আমরা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব না। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ জনগণের আস্থা অর্জন করার পাশাপাশি রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা বাস্তবায়ন করা। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে দেশ পিছিয়ে যাবে।

বিএনপির নেতারা মনে করেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে ফেরার পর বিএনপির নির্বাচনি প্রচারণায় এক অভাবনীয় উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে। ১৭ বছর ধরে দলের নেতাকর্মীরা কেবল প্রযুক্তির পর্দায় নেতাকে দেখেছেন; কিন্তু সশরীরে পাশে পাওয়ার যে মানসিক শক্তি, তা ছিল অনুপস্থিত। ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমান যখন ঢাকার রাজপথে নামবেন, তখন তা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে।

মাঠ পর্যায়ের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করা বিশ্লেষকরা বলছেন, দূর থেকে নির্দেশনা দেওয়া আর সেনাপতির মতো সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তারেক রহমানের উপস্থিতি বিএনপির ঝিমিয়ে পড়া বা দ্বিধাগ্রস্ত কর্মীদের মধ্যে যে ত্বরিত গতির জাগরণ তৈরি করবে, তা নির্বাচনের মাঠের চেহারাই বদলে দেবে। কর্মীরা জানবে, তাদের নেতা তাদের সঙ্গেই আছেন। সাধারণ ভোটার, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ভোটারদের ওপরও এর বিশাল প্রভাব পড়বে। গত দেড় যুগে যারা নতুন ভোটার হয়েছেন, তারা তারেক রহমানকে সরাসরি দেখবেন, তার পরিকল্পনা শুনবেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি যুগান্তরকে বলেন, রাজনীতিতে গুণগত যে পরিবর্তন, তারেক রহমানের বক্তব্যে বোঝা যায়। তারেক রহমান যে কথাগুলো বলছেন, এ কথাগুলার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আজ তারেক রহমান সে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা ভোটাররা সাধারণত বিজয়ী দলের দিকেই ঝুঁকতে পছন্দ করেন। তারেক রহমানের নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড দেখে এই নীরব ভোটারদের ভোটের স্রোত ধানের শীষের দিকেই ধাবিত হতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, সামনে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিএনপির বিরুদ্ধে অনেক কথাবার্তা ছড়ানো হচ্ছে, এগুলোর যুক্তিসংগত এবং বিশ্বাসযোগ্য জবাব দেওয়া। নির্বাচনের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে নানা জায়গায় গোলযোগ হচ্ছে, প্রতিবাদ হচ্ছে, তা শান্ত করা। সব পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। সমর্থক এবং জনগণকে আশ্বস্ত করা যে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার পথ থেকে বিএনপি বিচ্যুত হয়নি। এরপর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই অস্থির অবস্থায় আছে। এ অস্থিরতার মধ্যে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, দলের অন্যান্য নেতার নিরাপত্তা, সার্বিকভাবে দেশের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।

তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পরপর যে ঐক্য ছিল, সেই ঐক্যে এখন ফাটল ধরেছে। সেই ঐক্য আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। যাতে বাংলাদেশ যে কোনো বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ, আগ্রাসন ইত্যাদি মোকাবিলা করতে পারে। সার্বিকভাবে জাতীয় ঐক্য বজায় রেখে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনি এলাকার বিভিন্ন জায়গায় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিএনপি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাচ্ছে। তারেক রহমানকে দলের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নিতে হবে তৃণমূল পর্যন্ত। আর নির্বাচনের পরের চ্যালেঞ্জ হলো-আমাদের তরুণ প্রজন্ম চায় বাংলাদেশের যে মালিকানা, এটা জনগণের হাতে ফেরত দিতে হবে। সেই কাজটি করতে হবে বিএনপির শীর্ষ নেতাকে। তিনি বলেন, এখানে নানারকমের ফোর্স আছে, বাইরের শক্তি আছে। নিজেদের ভেতরে ডিভিশন আছে। তারেক রহমানের একটা বড় পরিসরে ঐক্য তৈরি করতে হবে। ঐক্য মানে পার্টির ঐক্য না। জনগণের সাপোর্টের একটা ঐক্য করতে হবে। এটাও তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। আরেকটা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি দূর করলে বাংলাদেশের সমস্যা অর্ধেক সমাধান হয়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ভোটের আগের চ্যালেঞ্জ হলো বিএনপিকে সংগঠিত রাখা। দলকে পূর্ণ শক্তি নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া। যারা দলে বিদ্রোহী প্রার্থী হতে চান, তাদের নিবৃত্ত করা, বিদ্রোহী যাতে না হতে পারেন। নির্বাচনি প্রচারণাও যথাযথভাবে করতে হবে। ভোটের মাঠে অন্যান্য দলের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হলো বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ। খেয়াল রাখতে হবে বিএনপির প্রচারণা অন্যান্য দলের চেয়ে যেন দুর্বল না হয়। আর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রশাসনের ভূমিকা যেন নির্বাচনকালীন বিএনপির বিরুদ্ধে না যায়। কেউ যেন বিএনপিকে প্রশাসনিকভাবে দুর্বল করতে না পারে, এটা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে খেয়াল রাখতে হবে নির্বাচনের সময়।

তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয়, তারেক রহমান ফিরে এলে একধরনের শৃঙ্খলা চলে আসবে। দলের পাশাপাশি দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে স্বস্তি দেখা দেবে। বিএনপি মাঠে-ময়দানে যে অঙ্গীকার করছে, এর বাস্তবায়ন করে দলটিকে দেখাতে হবে।

সামাজিক শৃঙ্খলা এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে যা যা করার প্রয়োজন, তা করতে হবে। এটা করতে পারাটাই বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের মানুষকে সুশাসন দিতে হবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, বাংলাদেশকে ঘিরে একটা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ইতোমধ্যে স্পষ্ট। একটা ফেইল স্টেট বানানোর অপচেষ্টা আছে। নির্বাচনে জেতার আগেই তারেক রহমানের একটা দায়িত্ব হলো ফেইল স্টেটের ষড়যন্ত্র থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা। আসলে বাংলাদেশের যে কোনো রাজনীতিক দেশপ্রেমিক মানুষেরই এটা কর্তব্য। তিনি যেহেতু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা দলের শীর্ষ নেতা, ফলে তার দায়িত্ব অন্যদের চেয়ে বেশি। এ মুহূর্তে এটা প্রধান চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে যদি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হয়ও, পরদিন থেকে এখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্তই থাকবে; যা হবে অনেক কারণে। একটা কারণ হলো-আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। ফলে ওরা রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করবে। তারপর এখানে ইতোমধ্যে একটা দক্ষিণপন্থি রাজনীতির উত্থান ঘটে গেছে। তারা তো আর নির্বাচনপন্থি না। তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার আলাদা একটা ধরন আছে। তারাও চাইবে তাদের রাজনীতি নিয়ে ক্ষমতায় যেতে। একদিকে আওয়ামী লীগের উত্থান বা ফিরে আসার চেষ্টা, আরেকদিকে দক্ষিণপন্থিদের উত্থান-এই দুটো তারেক রহমানের, মানে পরবর্তী সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো, একটা মহল তো স্পষ্টই চেষ্টা করছে যে কোনোভাবে নির্বাচনকে বানচাল করতে এবং বিএনপিকে যেন ঠেকানো যায়। সেটা তারেক রহমানের ব্যক্তিগত এবং দলীয় চ্যালেঞ্জ। এখন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে তারেক রহমানের অবশ্যই একটা দক্ষ ও দেশপ্রেমিক মধ্যপন্থি রাজনৈতিক টিম দরকার। আবার কূটনীতির ক্ষেত্রেও একটা নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া উচিত হবে। সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, আমরা কাউকে শত্রু বানাব না-এই পলিসিতে ফিরে যেতে হবে।