Image description

ভারতীয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ কেনা নিয়ে বিপাকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি। কারণ, বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক অন্যান্য কেন্দ্র, এমনকি ভারতের অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় আদানির বিদ্যুতের দাম অনেক। দাম বেশি হওয়ায় আদানির বিদ্যুৎ কিনে গত দুই বছরে পিডিবির লোকসান হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত বছর লোকসান হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যাপারে পিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি সরকারকে অবগত করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ কেনার বিষয়ে ২০১৭ সালে আদানি শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদের চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডা এলাকায় আদানির দুটি বিদ্যুৎ ইউনিটে উৎপাদিত ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে বাংলাদেশ তথা পিডিবিকে। না কিনলে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ ছাড়া বিভিন্ন চার্জ দিতে হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, আদানির বিদ্যুৎ ও কয়লার দাম দুটিতেই ঠকছে বাংলাদেশ। এ দুটির দাম অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় বেশি। এ কারণে গত তিন অর্থবছর বিদ্যুৎ আমদানি করে পিডিবি ২১ হাজার ১১৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এর মধ্যে শুধু আদানির বিদ্যুৎ কিনে লোকসান হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।

জানা যায়, চুক্তি অনুযায়ী আদানি গ্রুপ থেকে কোনো বিদ্যুৎ না কিনলেও প্রতিমাসে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে ৪৫০ কোটি টাকার বেশি দিতে হচ্ছে। শুধু গত দুই অর্থবছরে বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ আদানিকে বিল দেওয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৮০ কোটি ৩৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। সবমিলে এ পর্যন্ত বিল দিতে হয়েছে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা।

সবকিছুতে দাম বেশি আদানির : পিডিবির হিসাবে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ পরে প্রতি ইউনিট ২২ টাকা। এর বাইরে গ্যাস এবং কয়লাভিত্তিক সব কেন্দ্রের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে আদানির বিদ্যুৎ। এমনকি দেশের ১৪০টির বেশি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের-আইপিপির (কয়লা, ফানের্স অয়েল ও গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র) গড় উৎপাদন মূল্যের চেয়ে বেশি দামে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, পিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রতি ইউনিট ৯ টাকা ২৬ পয়সা, সরকারি অন্যান্য কেন্দ্রে ৭ টাকা ১৫ পয়সা, সব আইপিপির (ফার্নেস অয়েল, কয়লা ও গ্যাস) উৎপাদন খরচ ১৪ টাকা ৫৬ পয়সা এবং ভাড়ার প্ল্যান্টে ৬ টাকা ৫২ পয়সা খরচ হয়। আর ভারতের অন্যান্য কোম্পানি এবং নেপাল থেকে আমদানি করা বিদ্যুতে খরচ হয় প্রতি ইউনিট ৮ টাকা ৭১ পয়সা। কিন্তু আদানিকে প্রতি ইউনিটে দিতে হচ্ছে ১৪ টাকা ৮৬ পয়সা। পিডিবির হিসাবে এ বছর আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় মূল্য পড়েছে ১২.১৬ মার্কিন সেন্ট। সেখানে অন্য সব (৬টি ) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল্য ছিল ১১ দশমিক ৩০ সেন্ট।

কয়লার দামেও খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পায়রা ১২৪৪ মেগাওয়াট কেন্দ্রের কয়লার মূল্য পিডিবি দিয়েছে গড়ে প্রতি টন ৭৬ দশমিক ১৬ ডলার, বাংলাদেশ-ভারত ১২৩৪ মেগাওয়াটের মৈত্রী কেন্দ্রের কয়লার দাম প্রতি টন ৭৩ দশমিক ৮৪ ডলার, এস আলম গ্রুপের ১২২৪ মেগাওয়াটের এসএস পাওয়ারের কেন্দ্রের কয়লার দাম ৭১ দশমিক ৪৯ ডলার, বরিশাল কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের কয়লার দাম প্রতি টন ৭৫ দশমিক ৩৮ ডলার। সেখানে আদানির কয়লার দাম পিডিবিকে দিতে হয়েছে প্রতি টন ৭৬ দশমিক ৯১ ডলার।

আদানি অস্ট্রেলিয়ায় কয়লার খনি কিনেছে। সেই খনির কয়লা গড্ডা কেন্দ্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে করা চুক্তিতে কয়লার মূল্য নির্ধারণের ইনডেক্স নির্ধারণ করেছে নিউকেসেল ও এইচবিএ-২, যা অন্য কোনো বেসরকারি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের জন্য নির্ধারণ করা হয়নি। এখন এই কয়লার দাম নির্ধারণ নিয়ে পিডিবির সঙ্গে চরম বিরোধ চলছে আদানির। সেই বিরোধের মীমাংসা করতে সিঙ্গাপুরের আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে আদানি। তবে আদানির একজন মুখপাত্র গত মাসে যুগান্তরকে ইমেইলে জানান, তারা বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির পক্ষে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চান। গত নভেম্বরের শেষে বিরোধপূর্ণ বিল ছাড়াও পিডিবির কাছে তাদের পাওনা ছিল ৩৫ কোটি ডলার। এ কারণে গত মাসে তারা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের নোটিশ দিয়েছিল। এরপর তাদের তিন কোটি ডলার বকেয়া পরিশোধ করলে আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখে।

আদানি কতটা বোঝা বাংলাদেশের জন্য : বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ২৮ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর মধ্যে আদানি সরবরাহ করে ১৬০০ মেগাওয়াট। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ সালে পিডিবি ১২ হাজার ১৪৬ কোটি ৯৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৪৫ টাকা এবং ২০২৪-২০২৫ সালে ১১ হাজার ৯৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ৬০ হাজার ৫৬২ টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে। কোনো বিদ্যুৎ না কিনলেও প্রতিমাসে ৪৫০ কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় পিডিবিকে। এক হিসাবে দেখা যায়, শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে প্রতিবছর আদানিকে দিতে হয় ৩৩১ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার। আদানির সঙ্গে সরকারের চুক্তি ২৫ বছর। সেই হিসাবে ২৫ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে ৮ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। টাকা অঙ্কে দাঁড়ায় ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। গত সরকারের আমলে ৩ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলারে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়। আদানির ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাব করলে প্রায় তিনটি পদ্মা সেতু বসানো যাবে।

এ বিষয়ে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের চুক্তি দেশের জন্য চেলেঞ্জের। এখন সমাঝোতা বা আলোচনা করে তাদের কাছ থেকে কম দামে বিদ্যুৎ কেনা যেতে পারে। এজন্য পিডিবির একটি পরিকল্পনা থাকা দরকার।

অনলাইন পাওয়ার নিউজের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ভারতের মধ্যপ্রদেশে এমপি পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে কয়লাভিত্তিক ১ দশমিক ৬ গিগাওয়াটের একটি কেন্দ্র বসানোর চুক্তি হয় টোরেন্ট পাওয়ারের। আড়াই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সেই কেন্দ্র থেকে এমপি পাওয়ারকে (মধ্যপ্রদেশ পাওয়ার) প্রতি ইউনিট ৫ দশমিক ৮২৯ রুপিতে (৮ টাকা ২৫ পয়সা) বিদ্যুৎ বিক্রি করবে টোরেন্ট পাওয়ার। এই বিদ্যুতের দাম আদানির বিদ্যুতের দামের অর্ধেক।