Image description

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চায় বিভিন্ন দেশ। তবে নির্বাচনের আগে নিরাপত্তা নিয়ে তাদের মধ্যে আছে উদ্বেগ। কূটনীতিক ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিয়ে আশ্বস্ত করতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আল সিয়াম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সেদিন ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, জাতিসংঘের কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তাসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে জানানো হয়। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জন্য নির্বাচন কমিশন পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে বলেও এ সময় আশ্বস্ত করা হয়।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে বিভিন্ন দেশ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে সেই বার্তাগুলো দেওয়া হয়েছে। তারা ঘোষিত সূচি অনুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত একটি সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী বলেও বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে। এতে করে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের চাপ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন

এ প্রসঙ্গে ঢাকায় ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার সম্প্রতি জানিয়েছেন, ২০০৮ সালের পর এই প্রথম ইইউ বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে। এই দলে ১৫০ থেকে ২০০ জন সদস্য থাকতে পারেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভোটের প্রায় ছয় সপ্তাহ আগে, অন্যরা ভোটের এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে পৌঁছাবেন। এছাড়া ভোটের সময় স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিয়োগেও ইইউ সহায়তা করবে।

ইইউ ছাড়াও অন্যান্য যারা পর্যবেক্ষক পাঠাতে আগ্রহী তাদের মধ্যে আছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই), কমনওয়েলথসহ আন্তর্জাতিক বেশ কিছু সংস্থা।

নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে কয়েকটি দেশ। একদিকে, ভারতীয় হাইকমিশন ঘিরে কর্মসূচি এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে ভিসা সেন্টার বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখছে দেশগুলো। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য সতর্কতাও জারি করেছে। গত ১৫ ডিসেম্বর জারি করা মার্কিন সতর্কতায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সংসদ নির্বাচন এবং জাতীয় গণভোট একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করেছে। নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সমাবেশ এবং বিক্ষোভ আরও ঘন ঘন ও তীব্র হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন নাগরিকদের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। পাশাপাশি মনে রাখা উচিত যে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে এবং সহিংসতা ঘটতে পারে।

মার্কিন নাগরিকদের বিক্ষোভ এড়াতে এবং যেকোনও বড় সমাবেশের আশপাশে সতর্কতা অবলম্বন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকা, হালনাগাদ তথ্যের জন্য স্থানীয় গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ, ভিড় ও বিক্ষোভ এড়িয়ে চলতে মার্কিন নাগরিকদের করণীয় হিসেবে পরামর্শ দিয়েছে ঢাকার দূতাবাস। যেকোনও ধরনের সহায়তার জন্য ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগের উপদেশ দেওয়া হয়েছে মার্কিন নাগরিকদের।

এদিকে, ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, মিশন ঘেরাও কর্মসূচির ঘোষণা থাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মনে করি, সফল হয়েছি।

নিরাপত্তা নিয়ে আশ্বস্ত করেছে ঢাকা

পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আল সিয়াম কূটনীতিকদের ব্রিফে নিরাপত্তা প্রস্তুতি সম্পর্কে বৃহস্পতিবার অবহিত করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রিফিং প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে হয়। সেদিন কয়েকজন রাষ্ট্রদূত কয়েকটি বিয়য়ে প্রশ্ন রাখেন পররাষ্ট্র সচিবের সামনে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, নির্বাচনে আরও কিছু দেশ পর্যবেক্ষক পাঠাতে চায়, তবে নিরাপত্তা নিয়ে কিছু দ্বিধা থাকায় তারা প্রশ্ন তোলেন। এ সময় তাদের আশ্বস্ত করা হয় যে, ঢাকার কূটনীতিক মিশন এবং পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা যথাযথভাবে নিশ্চিত করা হবে।

এছাড়া পররাষ্ট্র সচিব নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রস্তুতি কূটনীতিকদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি জানান, গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

ব্রিফিং শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের প্রস্তুতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলোকে অবহিত করতে কূটনীতিকদের জন্য এ ব্রিফিং আয়োজন করা হয়েছে। ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের জানানো হয়েছে, নির্বাচন কমিশন বিদেশি পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাবে।

পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম কূটনীতিকদের জানান, সশস্ত্র বাহিনীসহ দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সক্রিয় আছে। এছাড়া, দূতাবাসগুলোকে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে।      

সূত্র জানায়, পররাষ্ট্র সচিব কূটনীতিকদের জানিয়েছেন- ডিপ্লোম্যাটিক মিশনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পুলিশ ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা নিরাপত্তা নিশ্চিতে সমন্বয় করে কাজ করছে। কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পররাষ্ট্র সচিব কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করেছেন, যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিনি জানান, সরকার শুধু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নয়, নির্বাচনের আগে এবং পরে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে। তিনি কূটনীতিকদের কাছে দাবি করেছেন, বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেলেও নির্বাচনকে ঘিরে বড় ধরনের কোনও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেনি।    

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে পশ্চিমাদের তাগিদ

দেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার তাগিদ দিয়ে আসছে পশ্চিমাসহ বেশ কিছু দেশ ও জাতিসংঘ। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক করেছেন। প্রতিটি বৈঠক থেকেই একটি বার্তা পাওয়া গেছে, তা হচ্ছে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সময়মতো সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে। তারাও আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আশা করছে। নির্বাচন নিয়ে ইসির সঙ্গে আলাপ করেছেন জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লটজ।

তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন। এমন একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন যাতে বিভিন্ন দল অংশগ্রহণ করতে পারে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রত্যাশা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।’ 

পশ্চিমাদের বার্তা প্রসঙ্গে ঢাকার সাবেক এক কূটনীতিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিগত তিনটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকবার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়েও বলেছে। তাই এই নির্বাচনের গুরুত্ব পশ্চিমাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে পুরো বিশ্ব কিন্তু তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। বিশেষ করে অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ তাদের মনোযোগের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।’ 

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে গঠিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাইছে অনেক দেশ। অনেক দেশই এখনও উন্নয়নমূলক কাজে বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এর সঙ্গে নির্বাচন জড়িত। তাই একটি সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাচ্ছে।’

তবে নিরাপত্তা নিয়ে চ্যালেঞ্জও আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সিকিউরিটি একটা ইস্যু। এটা খুব শক্তভাবে মোকাবিলা করতে হবে। বিশেষ করে বিদেশি মিশন এবং নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের জন্য। সেটা করতে না পারলে বাইরে অনেক নেতিবাচক একটা বার্তা যাবে। বিশেষ করে সম্প্রতি দুটি শীর্ষ গণমাধ্যম আক্রান্ত হওয়াকে কেউ ভালো চোখে কেউ দেখছে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত জরুরি।’

শান্তিপূর্ণ নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে বার্তা দিয়েছে জাতিসংঘও। সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনি পরিবেশ বজায় রাখতে সংযম দেখানোর অনুরোধও করেছেন জাতিসংঘ মহাসিচব আন্তোনিও গুতেরেস ।