Image description

যখন কোনো জনপ্রিয় নেতা বা নিরীহ নাগরিককে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়, তখন জনতার মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। এই ক্ষোভ প্রায়শই রাস্তায় প্রতিবাদ, ভাঙচুর বা দাঙ্গায় রূপ নেয়। এটাকে শুধু “অন্ধ হিংসা” বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না; বরং এটা দীর্ঘদিনের অন্যায়, অবিচার এবং অসহায়ত্বের সঞ্চিত ফল।

মনোবিজ্ঞানীরা এটাকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ভাষায় “the language of the unheard” বলে অভিহিত করেছেন—যাদের কথা কেউ শোনে না, তাদের ভাষা। সোশ্যাল সাইকোলজিতে এটাকে “collective frustration” বলা হয়, যেখানে গ্রুপ আইডেন্টিটি এবং শেয়ার্ড গ্রিভ্যান্স ক্রোধকে আরও তীব্র করে তোলে। এমন ঘটনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটেছে এবং এটা প্রায়শই সিস্টেমের উপর চাপ সৃষ্টি করে পরিবর্তন আনে।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৮ সালে আমেরিকায় মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের হত্যার পর ১১০টিরও বেশি শহরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে (Holy Week Uprising)। ওয়াশিংটন ডিসি, শিকাগো, বাল্টিমোরে হাজার হাজার ভবন পোড়ানো হয়, লুটপাট চলে। ৪৩ জন নিহত, ৩,৫০০ আহত এবং ২৭,০০০ গ্রেপ্তার হয়। এটা ছিল রেসিয়াল ইনজাস্টিস, পুলিশ ব্রুটালিটি এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনতার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। ফলস্বরূপ, সিভিল রাইটস অ্যাক্ট পাস হয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।

একইভাবে, ১৯৯২ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে রডনি কিং-এর উপর পুলিশের নৃশংস মারধরের ভিডিও প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও চারজন অফিসারকে খালাস দেওয়া হয়। আদালতের রায়ের পর ছয় দিনের দাঙ্গায় ৫৩ জন নিহত, ২,০০০-এর বেশি আহত এবং ১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়। লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর—সবই ছিল পুলিশ ব্রুটালিটি এবং রেসিয়াল ইনজাস্টিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ রিফর্মের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়।

যদি শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যা না করা হতো, এবং হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হতো, তাহলে মানুষ রাস্তায় নেমে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ভাঙচুর করত না, প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের অফিসে আগুন ও ভাঙচুর চালাত না। আমরা প্রায়শই প্রিভেনটিভ ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু লক্ষণ (symptom) দমনে মনোযোগ দিই। লক্ষণের সমালোচনা করি, কিন্তু ভুলে যাই যে জনতার এই বিক্ষোভ তাদের দীর্ঘদিনের frustration-এর বহিঃপ্রকাশ। সরকারের উচিত ছিল এই frustration যাতে জন্ম না নেয়, সেদিকে নজর দেওয়া—অর্থাৎ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি দেওয়া।

আমি মব ভায়োলেন্সকে কোনোভাবেই সমর্থন করি না। এটা নিন্দনীয় অপরাধ। কিন্তু সরকারের—বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর—সমালোচনা করছি: তারা কেন এমন খুনিদের খোলামেলা ছেড়ে রেখেছে? গুলি করার পর ছয় দিন পার হয়ে গেলেও কেন তাদের ধরতে পারেনি? তারা চার ঘণ্টার মধ্যে খুনির অবস্থান জানতে পারে, কিন্তু ধরতে পারে না—এটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। অনেকে মনে করেন, তারা জেনেশুনে খুনিদের পালাতে সাহায্য করেছে। এই ব্যর্থতা এবং অবহেলাই জনক্ষোভকে উসকে দিয়েছে।

আর সুশীল সমাজের প্রতি বলব: আপনাদের এই সিলেকটিভ সুশীলতা দেখতে দেখতে জনগণ বিরক্ত হয়ে উঠেছে। সবাই জানে আপনারা কতটা “সুশীল”। আপনারা রাস্তায় নেমেছেন প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে হামলার নিন্দায়, কিন্তু খুনি কেন ধরা পড়েনি, কেন ন্যায়বিচার হচ্ছে না—সেই প্রশ্ন কেন তুলছেন না? আপনারা শুধু মবের দিকে আঙুল তোলেন, খুনি এবং তাদের সহায়কদের দিকে নয়।

নো ওয়ান্ডার বাংলাদেশে এখন বুদ্ধিজীবীদের গভীর সংকট চলছে। যাকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়, দু’দিন পর তাকেই পরজীবীতে পরিণত হতে দেখি।

ফিরে আসি মূল কথায়: মব ভায়োলেন্স নিন্দনীয় এবং অপরাধ। কিন্তু মব ভায়োলেন্স যাতে না হয়, সেজন্য রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অভাব এবং অবহেলা আরও বেশি নিন্দনীয়।

হাদি খুন না হলে এই ভায়োলেন্স হতো না। হাদির হত্যাকারীদের দ্রুত ধরা পড়লে এবং বিচার হলে এই অরাজকতা এড়ানো যেত। ন্যায়বিচারই পারে জনক্ষোভকে শান্ত করতে—হিংসা নয়।