২০২৫ সালের ১৮ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ভয়াবহ দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ দিনটি সেই দিন, যেদিন ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের এক উজ্জ্বল নায়ক ওসমান হাদি কয়েক দিন আগে সংঘটিত এক হত্যাচেষ্টায় গুলিতে আঘাতের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানেন। ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার সহযোদ্ধা ছাত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে এবং যারা তার দৃঢ় ও সাহসী কণ্ঠকে ভালোবেসেছিলেন- সবার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই আবেগ ও ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। হাদি যা কিছু বলেছেন, তার সবকিছুর সঙ্গে একমত না হলেও- তাকে শ্রদ্ধা করা এবং বিশ্বাস করা সহজ ছিল যে, তিনি ‘বাংলাদেশ ২.০’ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
গুলি চালানোর পরবর্তী দিনগুলোতে যখন তার আঘাতের মাত্রা সম্পর্কে তথ্য ছড়িয়ে পড়ে, তখন সচেতন পর্যবেক্ষকদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়- তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অলৌকিক কিছু না ঘটলে জাতিকে শিগগিরই তার উপস্থিতি থেকে বঞ্চিত হতে হবে- এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল।
হাদির হামলাকারীর পরিচয় ও অবস্থান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকদিন ধরেই গুজব ছড়ালেও তদন্ত চলাকালে সরকারি সূত্রগুলো নীরবতা বজায় রাখে। কিন্তু কে বা কারা হাদির কণ্ঠ স্তব্ধ করতে এবং বাংলাদেশের নড়বড়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণকে অস্থিতিশীল করতে আগ্রহী হতে পারে-সেটা বিবেচনা করলেই দ্রুত সন্দেহ গিয়ে পড়ে সাবেক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শক্তিগুলোর দিকে। দেশে ও বিদেশে সাবেক শাসকগোষ্ঠীর সমর্থকদের অসংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া এই বিশ্বাসকে আরও জোরালো করে যে, হামলার পেছনে তারাই দায়ী। এছাড়া হাদির ওপর এই হামলাই যে শেষ নয়- এমন আশঙ্কাও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অনলাইনে কথিত ‘হিট লিস্ট’-এর গুজবও ঘুরে বেড়াতে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশংসনীয়ভাবে দ্রুত হাদি ও তার পরিবারের পাশে দাঁড়ায়- যদিও তার সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তখন খুবই ক্ষীণ। এর অংশ হিসেবে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সব বর্ণনা থেকেই স্পষ্ট, ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের প্রতি তিনি দীর্ঘদিন ধরেই এক ধরনের পিতৃসুলভ স্নেহ প্রদর্শন করে আসছেন। নিঃসন্দেহে তিনি এটাও ভালোভাবেই বুঝেছিলেন- হাদির মৃত্যু অন্যান্য ছাত্রনেতা এবং চলমান নাজুক রাজনৈতিক উত্তরণের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। হাদির মৃত্যুর পর দেয়া বক্তব্যসহ প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড- সব ক্ষেত্রেই প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ধারাবাহিকভাবে এ কথাই জোর দিয়ে বলেছেন যে, হাদি’কে সম্মান জানানোর প্রকৃত উপায় হলো তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করা।
একই সঙ্গে রাজনৈতিক পরিসরের বিভিন্ন শক্তি- যাদের মধ্যে সাবেক শাসকগোষ্ঠীও রয়েছে- এই উত্তরণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে চায়, তারা হাদির মৃত্যুকে কাজে লাগাতে এক মুহূর্তও দেরি করেনি। দেশীয় রাজনীতির বাইরেও, ওসমান হাদির ওপর হামলা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নের যেকোনো প্রচেষ্টার জন্য একটি গুরুতর আঘাত হয়ে এসেছে। হামলাকারী ভারত থেকে আগে বা পরে নির্দেশ বা সহায়তা পেয়েছিল কি না তার নিরিখে এই ঘটনা আবারও সামনে এনে দিয়েছে যে সাবেক শাসনামলের শত শত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এখনও ভারতে অবস্থান করছেন। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি, আর ভারত সরকারও তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই ভারতবিরোধী মনোভাব সহিংসতায় রূপ নিতে পারে- এর প্রমাণ মিলেছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলায়। তাদেরকে দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের ঘনিষ্ঠ বলে অভিযুক্ত করা হয়। হাদির মৃত্যুর খবরের পর আবেগের বিস্ফোরণ ও সহিংসতার যে ঢেউ দেখা যায়- তা যেমন অনুমানযোগ্য ছিল, তেমনি ছিল দুঃখজনক।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিঃসন্দেহে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বর্তায়। বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ বা মোকাবিলায় যেসব ব্যর্থতা ঘটেছে, তার জন্য দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা। বিশেষ করে যখন দেশ শোক পালন করছে। এর পরপরই বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বহু প্রতীক্ষিত দেশে প্রত্যাবর্তন ঘটবে। এই ঘটনাগুলো নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে এবং উত্তরণ প্রক্রিয়া ভেস্তে দিতে চাওয়া উস্কানিদাতারা সক্রিয় হলে আরও সহিংসতার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।