সঞ্চয়পত্রের মুনাফা আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে আরও কমতে পারে-এমন আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা, বিশেষ করে প্রবীণ ও অবসরপ্রাপ্তরা। অনেকের একমাত্র আয়ের উৎস সঞ্চয়পত্র। চলতি বছরের শুরুতেই একবার মুনাফা কমিয়ে দেওয়ায় ইতোমধ্যে তাদের আয় কমেছে। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ উপকারভোগীদের। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ২০২৫ সালের জুনে নেমে এসেছে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশে। অথচ ২০১৫ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ ও ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
বর্তমানে ব্যাংক আমানত, স্থায়ী আমানত-এফডিআর এবং সরকারি বন্ডে তুলনামূলক বেশি সুদ পাওয়া গেলেও অনেক বয়স্ক নাগরিক ও অবসরপ্রাপ্ত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, আরও ১ থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ পয়েন্ট সুদ কমানোর বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে সঞ্চয়পত্র আরও কম আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা আরও কমানোর সুযোগ খুবই সীমিত। তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ সুদের হার এখন ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ, অথচ মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর ১০ শতাংশ কর কেটে নেওয়ার পর প্রকৃত মুনাফা নেমে আসে মাত্র ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশে। এদিকে বাংলাদেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি, যা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। বয়স্কদের জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক বেশি, কারণ তাদের চিকিৎসা ও বার্ধক্যজনিত সেবায় অতিরিক্ত খরচ হয়।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে সরকারের সুদ পরিশোধ আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৫২ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনেক সঞ্চয়কারী এখন ট্রেজারি বন্ড, বিল ও এফডিআরের দিকে ঝুঁকছেন। তবে এখনো বড় একটি অংশ বিশেষ করে প্রবীণ নাগরিক, নারী, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ এবং অবসরপ্রাপ্তরা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল।
সঞ্চয়পত্র মূলত ছোট সঞ্চয় উৎসাহিত করা এবং নারী, প্রবীণ নাগরিক, প্রবাসী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে চালু করা হয়েছিল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, নারী ও প্রবীণদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বজায় রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজনে কর ছাড় বা বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা কঠোর করে ধনী বিনিয়োগকারীদের অপব্যবহার ঠেকানো যেতে পারে।
তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের অংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৭১ শতাংশে, যা ২০২৪ সালের জুনে ছিল ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের ওপর সঞ্চয়পত্রজনিত ঋণের চাপ ইতোমধ্যেই কমতে শুরু করেছে। ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের জুনের তুলনায় ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির শর্ত অনুযায়ী, বাজেট ঘাটতির সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশের বেশি সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে অর্থায়ন করা যাবে না। একই সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ নেমে এসেছে মাত্র ৩৩৭ কোটি টাকায়, যা এক বছর আগে ছিল ৮ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা অর্থাৎ ৯৬ শতাংশ কমেছে।
বর্তমানে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ১১টি সঞ্চয় স্কিম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে চারটি সঞ্চয়পত্র, দুটি পোস্ট অফিস সঞ্চয় ব্যাংক হিসাব, পোস্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রাইজ বন্ড এবং প্রবাসীদের জন্য তিনটি বিশেষ বন্ড।