‘‘আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি এ- কা...’’, দু’হাত ছড়িয়ে এই সাহসী উচ্চারণ ভুলবো না— শিক্ষকের উচ্চারণে, রাজনৈতিক সহযোদ্ধার কলমে এবং সামাজিক মাধ্যমে বৃহস্পতিবার থেকে ওসমান হাদিকে নিয়ে এ ধরনের হাজারও শোকগাঁথা। কিন্তু এ কেবল শোকগাঁথা নয়, স্বজন বন্ধুদের কণ্ঠে এক দাবি, এই রাজনৈতিক সহিংসতার বিচার হতে হবে। হাদি ইনকিলাব মঞ্চের কর্ণধার ছিলেন। দেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি সব সময় গঠনমূলক আলোচনা করতেন।
যেকোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। বিশেষ করে আধিপত্যবাদবিরোধী শক্তির বিপক্ষে তিনি সব সময় উচ্চকিত ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, মানুষের পক্ষে কাজ করবেন। তাই রাজনীতি না করলেও ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মাঠে নেমেছিলেন। নির্বাচনি প্রচারণার ১০ দিনে শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুদানের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব জনসমক্ষে প্রদান করেন। জুলাই পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য বারবার নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পক্ষে বুলন্দ আওয়াজ তোলেন। তবে সেই হাদিই আততায়ীর গুলিতে আহত হয়ে জীবনযুদ্ধে হেরে যান।
বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। হাদিকে শহীদ হিসেবে মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় হাদির মরদেহবাহী কফিন এসেছে দেশের মাটিতে। শনিবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুর ২টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে তার জানাজা সম্পন্ন হবে। সারা দেশের মানুষ শেষবারের বিদায় জানাবে তাকে।
হাদির এই মর্মন্তুদ ও অকাল বিদায়ের বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘হাদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন উদীয়মান তরুণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার সঙ্গে আমাদের অনেক বিষয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে। তবে সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়ে তার উচ্চকণ্ঠ দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে হয়তো রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজের জায়গা তৈরি করতে পারতেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকবে। তবে নিজের সক্রিয়তায় ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। নিশ্চয়ই এটি বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি করবে।’’ তবে তার মতো একজন তরুণ প্রার্থী ভোটের প্রচারণায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার দায় সরকার এড়াতে পারে না বলে মনে করেন প্রিন্স। তিনি আরও বলেন,, ‘‘এ নিয়ে কোনও সহিংসতাও কাম্য নয়।’’
ছিল ঢাকা-৮ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি
ওসমান হাদি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ (মতিঝিল, পল্টন, শাহজাহানপুর, শাহবাগ) আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই তিনি ব্যাপক জনসংযোগও শুরু করেন। তবে অন্য প্রার্থীদের মতো তিনি ব্যানার-ফেস্টুন বা পোস্টার করেননি। নিজের কিছু অনুসারী নিয়ে নির্বাচনি এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সীমিত প্রচারণা চালিয়েছেন। ইতোমধ্যে নির্বাচনি সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছিলেন। বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন— তিনি জনগণের জন্য কিছু করে যেতে চান। তাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। অবশ্য এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় হুমকি-ধামকি পাওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন গণমাধ্যমে। তার আসনে দুই বড় দল বিএনপির প্রার্থী দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও জামায়াতের প্রার্থী মহানগর দক্ষিণের নায়েবে আমির ড. হেলাল উদ্দিন।
শরীফ ওসমান হাদি প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই ঘোষণা দেন, তিনি নির্বাচনি আসনের প্রতিটি ভোটারের সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখেন, নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখ ভোটারের সর্বোচ্চ সংখ্যকের কাছে পৌঁছবেন। শুধু একবার না কয়েকবার দেখা করবেন। আর যেন নির্বাচনের দিন শুনতে না হয়, তোমাকে তো টিভিতে দেখেছি। এবার সরাসরি দেখলাম।’’
১০ দিনে প্রচারণায় প্রাপ্ত টাকার হিসাব দিয়ে গেছেন হাদি
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচনি প্রচারণায় নামেন শরীফ ওসমান হাদি। অন্যদের মতো বড় ধরনের শোডাউন দেননি। নিজের গুটি কয়েক নেতাকর্মী নিয়ে প্রায় প্রতিদিন কোনও না কোনও এলাকায় প্রচারণা চালান তিনি। হাদি জানিয়েছিলেন, নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি নিজস্ব কোনও অর্থ খরচ করেননি। শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে অনুদান দিচ্ছেন। গত ১১ ডিসেম্বর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে হাদি তার নির্বাচনি তহবিলে প্রাপ্ত টাকার হিসাব তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে মানুষ তাকে বিভিন্নভাবে ও উপায়ে টাকা-পয়সা পাঠিয়েছেন— যার পরিমাণ ৬ লাখ ২৪ হাজার ৮৮০ টাকা। এ নিয়ে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করার পর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণমানুষের কাছ থেকে হাদি মোট পেয়েছেন ২১ লাখ ৬৫ হাজার ২৯২ টাকা। এর আগে, গত ৩০ নভেম্বর রাতে নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে নির্বাচনি ক্যাম্পেইনের জন্য সমর্থকদের পাঠানো অনুদানের ২১ দিনের হিসাব প্রকাশ করেন হাদি। সেখানে ওসমান হাদি লেখেন, গত ৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তার নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে— ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৫৭ টাকা, বিকাশে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৯৮৯ টাকা, নগদে ৬ হাজার ২৮ টাকা, রকেটে ৩ হাজার ৮৩৮ টাকা। সব মিলিয়ে মোট ১৫ লাখ ৪০ হাজার ৪১২ টাকা জমা পড়েছে। তিনি জানান, নির্বাচন শেষে ডোনারদের গোপনীয়তা বজায় রেখে ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ পূর্ণ হিসাব প্রকাশ করা হবে। এর পরদিনই ১২ ডিসেম্বর গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
ভোটের মাঠে প্রথম টার্গেট
তফসিল ঘোষণার আগে টুকটাক প্রচারণা চালান হাদি। তবে তফিসল ঘোষণার দিন (১১ ডিসেম্বর) তিনি কাকরাইল ও সেগুনবাগিচা এলাকায় প্রচারণা চালান। সেদিন দুপুরে দুদক কার্যালয়ের সামনে ভোটারদের উদ্দেশে হ্যান্ড মাইকে বক্তব্য রাখেন।
পরদিন শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) বিজয়নগর কালভার্ট মোড়ে প্রচারণা শেষে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন। এটিই ছিল তার শেষ প্রচারণা। তাৎক্ষণিক তার সহকর্মীরা তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে রাতেই এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরদিন উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠে বিচ্ছিন্ন দুই-একটি হামলার ঘটনা ঘটলেও হাদির ওপর হামলাকে প্রথম ‘টার্গেট কিলিং’ হিসেবে দেখছেন দেশের মানুষ।
নির্বাচন ও গণতন্ত্রের কথা বলে গেলেন
যেকোনও বক্তব্যেই হাদি গণতন্ত্রের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বলতেন, বিএনপি ও জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরই স্বাধীন মত প্রকাশ করার অধিকার আছে। এমনকি আওয়ামী লীগের যারা অপরাধী নন, তাদের মতামত প্রকাশ করতে দেওয়া উচিত। কারণ, আমরা তো গণতন্ত্রের জন্যই বিগত ১৭ বছর আন্দোলন করেছি। কিন্তু এখনও যদি আগের মতো হয়, তাহলে কী লাভ হলো। তিনি বিএনপি-জামায়াতের ভুলগুলোর খোলামেলা সমালোচনা করেছেন। বলতেন, ‘বিএনপি ও জামায়াত কোনও অন্যায় করলেও ছাড় দেওয়া হবে না।’ আর এনসিপির বিষয়ে বলেন, ‘‘তারা সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছে জুলাইকে কুক্ষিগত করে। তাদের সতর্ক হওয়া উচিত।’’ জাতীয় নির্বাচনের বিষয়েও হাদি সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘‘নির্বাচন ছাড়া দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে না।’’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘কোনও অবস্থাতেই নির্বাচন পেছনোর সুযোগ নেই।’’
হাদিকে নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মূল্যায়ন
বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘হাদির বিষয়ে আগে তেমন ধারণা ছিল না। তবে তার কয়েকটি বক্তব্য দেখে মনে হলো— তার মধ্যে এক ধরনের তারুণ্যের অনুরণন আছে। তবে তার অনেক মতের সঙ্গেই আমি একমত নই। তারপরও মনে করি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার মতো উদীয়মান তরুণের দরকার ছিল। তার এভাবে চলে যাও সত্যিই বেদনাদায়ক।’’
রাজনীতিতে হাদির জীবনটা শুরু না হতেই নিভে গেলো উল্লেখ করে বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘‘তিনি সময়কে ধারণ করেছিলেন। জুলাইয়ে যে কয়জন তরুণ দ্রোহের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, হাদি তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তার বিয়োগে রাজনীতিতে বড় ধরনের রেখাপাত করলো। তবে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে আজীবন তরুণদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তিনি।’’