Image description

পিলখানায় সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা কি অবশ্যম্ভাবী ছিল, নাকি সময়মতো ব্যবস্থা নিলে তা প্রতিহত করা সম্ভব হতো—এই প্রশ্ন নতুন করে সামনে এসেছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর। প্রতিবেদনে হত্যাকাণ্ডের সময় র‌্যাবের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

এতে বলা হয়, ঘটনার শুরুতেই র‌্যাবের অগ্রবর্তী ইউনিটগুলো প্রস্তুত থাকলেও তাদের পিলখানায় প্রবেশ কিংবা গুলি চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। কার নির্দেশে সেই অনুমতি আটকে রাখা হয়েছিল এবং সময়মতো পদক্ষেপ নিলে কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড এড়ানো সম্ভব ছিল-এসব প্রশ্ন নতুন করে সামনে এসেছে কমিশনের অনুসন্ধানে। পিলখানার বিদ্রোহ তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গত ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেয়।

কমিশন বলছে, র‍্যাবের অগ্রগামী দলগুলো সময়মতো আক্রমণ পরিচালনা করলে বিডিআর হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হতো না। কিন্তু র‌্যাবের ডিজি হাসান মাহমুদ খন্দকার এবং এডিজি মেজর জেনারেল রেজানুর খান তাদের পিলখানায় প্রবেশের বা গুলি চালানোর অনুমতি দেননি। যদিও মেজর জেনারেল রেজানুর এজন্য মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিক ও মেজর জেনারেল জয়নুল আবেদীনকে (তৎকালীন ডিজি, এসএসএফ) দায়ী করেছেন। র‌্যাবের অগ্রগামী দলগুলো অনুমতির অপেক্ষা না করে আইন অনুযায়ী আক্রমণ চালালে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো না।

প্রতিবেদনে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ঘটনার শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আনুমানিক সকাল সোয়া ১০টায় লে. কর্নেল শামসুজ্জামানের নেতৃত্বে র‍্যাব ২-এর একটি দল সাতটি এসএমজি নিয়ে পিলখানার চার নম্বর গেটের কাছে পৌঁছায়। তখনো হত্যাকারীরা সংঘটিত হতে পারেনি এবং গেটটিতে মাত্র দু-তিনজন বিডিআর সদস্য অবস্থান করছিলেন।

সকাল ১০টার পরপরই র‍্যাব ২-এর দুটি প্লাটুন নিয়ে মেজর আমিন পিলখানার পাঁচ নম্বর গেটের কাছে অবস্থান নেন। কিন্তু ওই দুটি দলের কাউকেই তৎকালীন র‌্যাবের ডিজি হাসান মাহমুদ খন্দকার এবং এডিজি কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) রেজানুর ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেননি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাঁচ নম্বর গেট থেকে দরবার হলের দূরত্ব আনুমানিক ৫০ গজ।

প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী, র‍্যাবের ওই দুটি দল অনুমতি পেলে কিংবা অনুমতির অপেক্ষা না করে ভেতরে প্রবেশ করলে আনুমানিক ১০টা ৪০-এর দিকে শুরু হওয়া নৃশংস হত্যাকাণ্ড যেমন সংঘটিত হতো না, তেমনি পরবর্তী হত্যাকাণ্ডগুলো বিশেষ করে দরবার হলের পেছনে লুকিয়ে থাকা কর্মকর্তাদের হত্যা করা সম্ভব হতো না। বেলা পৌনে ১১টার পরপরই পাঁচ নম্বর গেটের কাছে অবস্থানরত দলটি নিকটবর্তী একটি বাসার ছাদ থেকে দরবার হলের সামনে পড়ে থাকা লাশ দেখতে পায়, যা পিলখানার বাইরে থেকে দেখা প্রথম লাশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি মেজর জেনারেল রেজানুর খান একই পোশাকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যমুনায় অবস্থান করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে তাকে যমুনা থেকে ফেরত যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। অন্যদিকে, আনুমানিক সকাল সোয়া ১০টায় লে. কর্নেল জাকিরের নেতৃত্বে র‍্যাব ৩-এর একটি দল পিলখানার তিন নম্বর গেটে পৌঁছায়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তারা কালক্ষেপণ না করে আক্রমণ পরিচালনা করলে ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন হতে পারত। পরবর্তীতে বিডিআর সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হলেও র‍্যাব-৩ পাল্টা গুলিবর্ষণ করেনি। র‍্যাব ৩-এর অধিনায়ক স্বীকার করেন, প্রথমে তাকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দরবার হলের সীমানা প্রাচীরের অংশ ভেঙে পিলখানায় প্রবেশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে অবস্থানে পৌঁছানোর পরপরই তাকে কোনো ধরনের আক্রমণ করতে নিষেধ করা হয়। সেনাবাহিনী আসার পর আর্টিলারি রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) জিয়া (পিলখানা কমিশনের প্রতিবেদনের এই অংশে তার পুরো নাম উল্লেখ করা হয়নি) লে. কর্নেল জাকিরকে পেছনে সরে যেতে এবং সেনাবাহিনীর নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছু না করতে অনুরোধ করেন।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, র‍্যাব ৩-এর অধিনায়ককে অবগত না করেই এর একটি ফাইটিং কোম্পানিকে কর্নেল রেজানুর খান যমুনায় মোতায়েন করার আদেশ দিয়েছিলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি র‍্যাব ৩-এর অধিনায়ককে ডিজি র‍্যাব জানিয়ে দেন, পরদিন পিলখানার দিকে একটি মিছিল যাবে এবং মিছিলটি যেন কোনো অরাজকতা করতে না পারে। পেছনে সরে আসার কারণে ওই মিছিল আদৌ হয়েছিল কি না, তা লে. কর্নেল জাকির জানতে পারেননি।

প্রতিবেদনে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় দায়িত্বরত পুলিশ ও র‍্যাব কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়েও গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবন, সম্ভ্রম এবং সম্পদ রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকা সত্ত্বেও তারা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন এবং ঘটনার রাজনৈতিক সমাধান-প্রহসনে সহায়তা করেছেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল যথাযথভাবে পরিবেষ্টন না করে অপরাধীদের বিভিন্ন গাড়িতে করে পিলখানা থেকে বেরিয়ে যেতে দেওয়া হয় এবং বিদ্রোহী-হত্যাকারী বিডিআর সদস্যদের দাবিমতো পুলিশকে দূরে সরিয়ে নিয়ে তাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত কথিত ‘সাধারণ ক্ষমা’র অজুহাতে পলাতক ও পলায়নপর বিডিআর অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এই অভিযোগের আওতায় রমনা বিভাগের ডিসি ও এডিসি, ধানমন্ডি, নিউ মার্কেট ও হাজারীবাগ থানার ওসি এবং পিআইরা, লালবাগ বিভাগের ডিসি ও এডিসি, লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি এবং পিআইরা, র‍্যাব ২-এর অধিনায়ক, উপ-অধিনায়ক, সংশ্লিষ্ট কোম্পানি কমান্ডার, পেট্রল দল এবং অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত হবেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।