Image description

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলি করে শুটাররা পালিয়ে যাওয়ার পর এখন নেপথ্যের কুশীলবদের গ্রেপ্তারে গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশ। সেই সঙ্গে হাদিকে গুলি করা অস্ত্র উদ্ধারে একাধিক স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার আগারগাঁওয়ে শুটার ফয়সালের বোনের বাসার পাশ থেকে গুলি, ম্যাগাজিন ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। গুলি করার পর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান এবং তার সহযোগী মোটরবাইক চালক আলমগীর হোসেন পালিয়ে যেতে যে প্রাইভেট কার ব্যবহার করেছিলেন, তার চালক নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া শুটার ফয়সালের মোটরসাইকেলের ভুয়া নম্বর প্লেট লাগানোর অভিযোগে তার পিতা হুমায়ুন কবিরকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

চিকিৎসক ও হাদির স্বজনরা জানিয়েছেন, হাদিকে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এর পর হাদির অবস্থার কিছুটা অবনতি হলেও এখন স্থিতিশীল রয়েছেন। গতকাল ওসমান হাদির ভেরিভায়েড ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, ওসমান হাদির প্রাইমারি টেস্টের পর অবস্থার কিছুটা অবনতি দেখা গেলেও বর্তমানে তা স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে। আরেকটি অপারেশনের প্রয়োজন, তবে সেটি করার মতো শারীরিক পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অস্ত্রের জোগানদাতাকে শনাক্ত করার কাজ করা হচ্ছে। নেপথ্যের কারিগরদের পাশাপাশি যারা আসামিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন, তাদেরকে গ্রেপ্তারের কাজ চলছে। সীমান্তে দুই আসামির পালিয়ে যাওয়ায় সহযোগিতা করা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের জন্য শনাক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়েছে, সেই অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কর্মকর্তারা বলছেন, মূল শুটার ফয়সালের মোটরসাইকেলে তার বাবা ভুয়া নম্বর প্লেট লাগিয়ে দেন। গুলি করে পালিয়ে যাওয়ার সময় সব জেনেও ফয়সালকে তার বাবা হুমায়ুন কবির সহযোগিতা করেছেন। তাকে নজরদারিতে

রাখা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ফয়সাল ও আলমগীর যে প্রাইভেট কারে সাভারের কালামপুর থেকে ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে গেছেন তার চালক নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর চালককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলÑ সারাদেশ ও সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি প্রচার হওয়ার পরও কেন আসামিদের তিনি সীমান্তে নিয়ে যান। চালক পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি বুঝতে পারেননি তারা শুটার।

এদিকে র‌্যাব-২-এর ক্যাম্প কমান্ডারের নেতৃত্বে সোমবার দিবাগত রাতে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের কর্নেল গলিতে ফয়সালের বোনের বাসায় অভিযান চালানোর পর বাসার পাশ থেকে গুলি ও ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়েছে। এ বিষয়ে র‌্যাব-২-এর ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মঞ্জুরুল কবির পিয়াল বলেন, ফয়সালের বোনের বাসার পাশ থেকে দুটি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ১১ রাউন্ড গুলি, ছয়টি পাসপোর্ট, চারটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এই ঘটনায় কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি।

অন্যদিকে হাদির ওপর হামলা হওয়ার কিছুদিন আগে ইনকিলাব মঞ্চের কার্যালয়ে যাওয়ার কথা আদালতকে বলেছেন প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদের সহযোগী কবির ওরফে দাঁতভাঙা কবির। মঙ্গলবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুজ্জামানের আদালতে রিমান্ড শুনানিতে তিনি এ কথা বলেন। শুনানি শেষে আদালত কবিরকে ৭ দিনের রিমান্ডে দেন। এর আগে সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকা থেকে কবিরকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর কাইয়ুম হোসেন নয়ন বলেন, কবির আদাবর থানার স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। যে মোটরসাইকেলযোগে প্রকাশ্য দিবালোকে হাদিকে গুলি করা হয়, সেখানে এ আসামি উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ফয়সালের সঙ্গে কবিরের যোগাযোগ ছিল। ফয়সালকে নিয়ে হাদির বাসায় যান কবির। ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। হাদিকে হত্যাচেষ্টার অস্ত্র ব্যবহার করেছেন কবির। আর তিনি মোটরসাইকেলের মালিক।

কবির আদালতকে বলেন, আমি উবার অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ি চালাতাম। মাঝে মধ্যে ফয়সাল করিম মাসুদ আমাকে ফোন দিতেন। আমাকে গুলশানসহ বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। তিনি আরও বলেন, মোটরসাইকেলটি আমার বন্ধু মাইনুদ্দিন ইসলাম শুভ কিনেছে। আমরা দুজনই একই দিনে গাড়ি কিনতে যাই। বন্ধু তার আইডি কার্ড দিয়ে গাড়ি কেনে। মোটরসাইকেলের সবকিছু ওর নামে, শুধু আমার আইডি কার্ড ব্যবহার করেছে। গাড়ি কেনার সময় উপস্থিত ছিলাম।

এদিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল জোনাল টিমের পরিদর্শক ফয়সাল আহম্মেদ কবিরের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা, নির্বাচনে আগ্রহী রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং প্রার্থীদের মনোবলকে দুর্বল করার জন্য ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়েছে। ঘটনার পরপর কবির আত্মগোপনে চলে যান। তিনি এ মামলার এজাহারনামীয় আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল দাউদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মামলার রহস্য উদ্ঘাটন ও সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড প্রয়োজন।

?কবির পটুয়াখালী সদর উপজেলার টিটকাটা এলাকার মৃত মোজাফফরের ছেলে। বর্তমানে তিনি কেরানীগঞ্জের আশ্বিনানগর এলাকায় বসবাস করছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক তদন্তে হামলার সঙ্গে জড়িত হিসেবে ফয়সাল করিম মাসুদ (প্রধান শুটার) এবং আলমগীর হোসেনকে (মোটরসাইকেল চালক) শনাক্ত করা হয়।

এর আগে গত সোমবার এ মামলার প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ শিপু এবং বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিন করে রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। এর আগের দিন রবিবার সন্দেহভাজন বাইকমালিক মো. আব্দুল হান্নানের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, রমনা ও শাহবাগ থানা এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন হাদি। সে জন্য প্রতি শুক্রবার তিনি জনসংযোগ করতেন। গত শুক্রবার দুপুরে মতিঝিলের একটি মসজিদে প্রচার শেষে সতীর্থদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের জন্য ব্যাটারি রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। যাওয়ার পথে বক্স কালভার্ট এলাকায় একটি মোটরসাইকেলে এসে হাদির মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে পালিয়ে যায় প্রধান আসামি ও চালক।

# প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করেছেন নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি