Image description
 
বাংলাদেশের সংসদকে প্রায় সময় “মহান জাতীয় সংসদ” বলে সম্মোধন করা হয়। বক্তৃতায় প্রায় সময়, এমনকি লিখিতভাবেও। এখন প্রশ্ন হলো: সংসদ মহান হয় কিভাবে? এটা তো কোনো তীর্থ স্থান বা ধর্মীয় উপাসনালয় নয় যে এটাকে “মহান” হিসেবে সম্মোধন করতে হবে। কেন সংসদের সাথে “মহান” বিশেষন যোগ করতে হবে তার যৌক্তিকতা আমি খোঁজে পাইনি। সংবিধানে তো নয়ই, এমন কি আন্তর্জাতিক রীতিনীতিতে পাইনি।
সাংবিধানিকভাবে ও রাষ্ট্রতত্ত্বের থিউরি অনুযায়ী তিনটি বিভাগ নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র গঠিত। আর সে বিভাগগুলো হলো: আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রদত্ত ও সংবিধানে সন্নিবেশিত Separation of Power এর কনসেপ্ট অনুযায়ী এই তিন বিভাগের কর্ম ও তৎপরতা আলাদা ও স্বতন্ত্র। এক বিভাগ আরেক বিভাগের অধীন বা অধস্তন নয়। তাহলে অন্য দুই বিভাগের বেলায় সম্মোধনের ক্ষেত্রে “মহান” বিশেষণ যোগ না করলে শুধু আইন বিভাগ তথা সংসদের ক্ষেত্রে কেন করতে হবে তার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা কোথাও নেই।
 
তিন বিভাগের মধ্যে বিচার বিভাগের অবস্থান আলাদা। সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের অভিভাবক (গার্ডিয়ান) বলা হয়। নির্বাহী বিভাগের যেকোনো সিদ্ধান্ত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট রিভিউ করতে পারে। সংবিধানের বেসিক স্ট্র্যাকচারে হাত দিয়েছে বা নষ্ট করেছে আইন বিভাগ কর্তৃক প্রনীত এমন যেকোনো আইন সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ও কর্তৃত্ব বহির্ভূত বলে ঘোষণা করতে পারে। রাষ্ট্রাচার (Warrant of Precedence) অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মান সংসদ সদস্যদের অনেক উপরে: এমপিদের ক্রমিক মান হচ্ছে ১২ আর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্টের বিচারপতির ক্রমিক মান হচ্ছে ৯ এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের ক্রমিক মান হচ্ছে ৮।
 
তাছাড়া প্রধান বিচারপতির আলাদা স্টেটাস ও মর্যাদা আছে। রাষ্ট্রাচারে তাঁর ক্রমিক মান ৩ বা ৪ (এক সময় ছিল ৩, পতিত সরকার ও তাদের পূর্বসূরীরা নামিয়েছিলেন ৪ এ, স্পীকারের ঠিক নীচে)। প্রধান বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নয় বরং “বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি” হিসেবে সংবিধান অভিহিত করেছে [অনুচ্ছেদ ৯৪(২)]। পতিত সরকার ও তাদের পূর্বসূরীদের আইন ও রেওয়াজ পরিবর্তনের আগে রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি তথা রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি শপথ দিতেন। রাষ্ট্রাচার ও সংবিধানে সুপ্রিম কোর্ট ও প্রধান বিচারপতির অবস্থান এত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদৃঢ় থাকার পরও যেখানে তাদের ক্ষেত্রে “মহান” বিশেষন ব্যবহার করা হয় না, সেখানে সংসদের ক্ষেত্রে কেন হবে?
বৃটিশ পার্লামেন্টকে তো মহান বা গ্রেট বলা হয় না। বৃটিশ পার্লামেন্টকে শুধু Parliament বা House of Commons বলে ডাকা হয় বা সম্মোধন করা হয়। অথচ বৃটিশ পার্লামেন্ট স্বাধীন ও সার্বভৌম। বাংলাদেশের সংসদ স্বাধীন হলেও সার্বভৌম নয়। বাংলাদেশে সার্বভৌম হচ্ছে জনগণ এবং জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে সংবিধান [অনুচ্ছেদ ৭(২)]। ভারতের সংসদও আমাদের মতো স্বাধীন হলেও সার্বভৌম নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে ও অলিখিত সংবিধানের দেশে বৃটিশ পার্লামেন্ট আছে এক স্বতন্ত্র অবস্থানে। সেটা অন্যান্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংসদের থেকে আলাদা। বৃটিশ পার্লামেন্টের ব্যাপারে বলা হয়, “British Parliament can make or unmake anything, except man into woman” (অর্থাৎ “ব্রিটিশ পার্লামেন্ট পুরুষকে নারীতে রূপান্তরিত করা ছাড়া আর যেকোনো কিছু তৈরি করতে পারে বা তৈরী করে ভাঙতে পারে”)। কই, এমন ক্ষমতাশালী পার্লামেন্টকেও তো “মহান” বা “গ্রেট” বলে সম্বোধন করা হয় না।
বৃটিশ পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট (Bicameral)। উচ্চকক্ষকে হাউস অব লর্ডস বলা হয়। উচ্চকক্ষ অনেক সম্মানের আসন হলেও ক্ষমতা ও ব্যুৎপত্তির দিক দিয়ে নিম্নকক্ষ তথা হাউস ও কমনসের নীচে। ইউকে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত অতীতে হাউস অব লর্ডস সর্বোচ্চ আদালত হিসেবেও কাজ করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এরপরও তো হাউস অব লর্ডসকে সম্মোধন করতে “মহান” বা “গ্রেট” বিশেষন ব্যবহার করা হয় না।
 
ব্রিটেনের রাষ্ট্রের প্রধান ও প্রতিক রাজাকে “হিজ ম্যাজেস্টি” বলে সম্বোধন করা হয়। অতীতে ছিলেন রানী, সেক্ষেত্রে বলা হতো “হ্যার ম্যাজিস্টি”। ব্রিটেন নামক রাষ্ট্রের নামের আগেও “গ্রেট” যোগ করে বলা হয় “গ্রেট ব্রিটেন”। তবে রাষ্ট্রের আভ্যন্তরিন কোন অঙ্গ বা বিভাগকে “মহান” বা “গ্রেট” হিসেবে কখনোই অভিহিত করা হয় না। গণপ্রজাতন্ত্রি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রধান ও প্রতিক হিসেবে রাষ্ট্রপতির পূর্বে “মহামান্য রাষ্ট্রপতি” হিসেবে সম্মোধন করা হয়। এটা ঠিক আছে। তবে রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ কোন অঙ্গ বা বিভাগকে “মহান” বলে সম্মোধনের যৌক্তিক কোন কারণ দেখা যায় না।
 
বাংলাদেশের মালিক জনগণ। সংবিধান অনুযায়ী জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস [অনুচ্চেদ ৭(১)]। দেশের মালিক ও সকল ক্ষমতার উৎস জনগণই সরাসরি ভোটে নির্বাচিত করত: তাদের প্রতিনিধি (এমপি) দ্বারা গঠন করে সংসদ। অথচ এই ভোট নিয়েই কত না লংকা কান্ড ঘটলো ও জালিয়াতি করা হলো গত ৫৪ বছরে। ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি), ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে প্রতারণার মাধ্যমে ও নির্বাচন এবং ভোটকে তামাশায় পরিণত করে জাতীয় সংসদ গঠন করা হলো। তাহলে সেই সংসদগুলোকেও “মহান” বলবেন বা বলতে হবে কোন যুক্তিতে বা কোন নৈতিক বলে?
 
জাতীয়ভাবে আমরা প্রায় সব কিছুতেই অতিরঞ্জিত করতে অভ্যস্ত জাতি। তাতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করি! যে যেটা না তাকে সেটা বানিয়ে ছাড়ি। যেমন: মেয়র নির্বাচিত হলেই তাকে সংশ্লিষ্ট সিটি বা শহরের পিতা বানিয়ে ফেলি! মেয়র নির্বাচিত হন জনগনের সেবা করার জন্য। তিনি বরং জনগনের সেবক, খাদেম বা পাবলিক সার্ভেন্ট। মূলত: জনগণের সেবা করার ওয়াদা করে ভোট চেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তাকে কেন “নগর পিতা” বলতে হবে? কিছু মিডিয়া ও সাংবাদিক এই উদ্ভট সংস্কৃতি চালু করেছেন আমাদের দেশে। এই সম্মোধনের না আছে কোন আইনী ব্যাখ্যা, না আছে সাংবিধানিক ভিত্তি। আচ্ছা, কোন মহিলা মেয়র প্রার্থী যদি মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হোন তাকে কি “নগর পিতা” বলবেন? তিনি তো হবেন বরং “নগর মাতা”!নারায়ণগঞ্জের নির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে কি “নগর পিতা” বলেন বা বলেছেন? তাকে কি “নগর মাতা” হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন?
 
ভোটে নির্বাচিত হলেই যদি কাউকে পিতা বলতে হয়, তাহলে তো সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদেরকে “ইউনিয়ন পিতা” বলতে হবে, সব উপজেলার চেয়ারম্যানদেরকে “উপজেলা পিতা” বলতে হবে, সব মেম্বারদেরকে/কমিশনারদেরকে “ওয়ার্ড পিতা” বলতে হবে, সব এমপিদেরকে “সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার পিতা” বলতে হবে। আর তাতে করে দেশ পিতায় ভরে যাবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিকে পিতা ডাকার এই উদ্ভট সংস্কৃতির দরকারই বা কি? আর সব জায়গায় পিতা কেন খুঁজতে হবে? ভোট দিয়ে ভোটাররা পিতা বানায় না, বানায় প্রতিনিধি বা সেবক। আমাদের এই উদ্ভট মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
 
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নগরী লন্ডনের বর্তমান মেয়র সাদিক খান সরাসরি ভোটে নির্বাচিত। দু’টার্ম ধরে মেয়র আছেন। অতীতে ছিলেন বরিস জনসন এবং কেন লিভিংস্টন দু’টার্ম করে। বরিস জনসন পরবর্তিতে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তারা যখন মেয়র ছিলেন কই কেউ তো তাদেরকে কখনও বলেনি “নগর পিতা” (City Father বা Father of the City)। বিশ্বের আরেক অন্যতম প্রধান ও আধুনিক নগর নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র প্রতি চার বছর পরপর প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হোন। সম্প্রতি একজন মুসলিম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। কই, কোন দিন শুনিনি ইয়র্ক সিটির মেয়রকে “নগর পিতা” বলতে। আমাদের দেশে এই দৈন্যদশা কেন?
 
অপরদিকে, সরারসরি নির্বাচিত হলেই যদি জাতীয় সংসদকে “মহান” বলতে হয়, তাহলে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ইউনিয়ন কাউন্সিল, উপজেলা পরিষদ ও সিটি কর্পোরেশন দোষ করলো কি? তাদের ক্ষেত্রে সম্মোধনে তাহলে “মহান” বিশেষণ যোগ করতে হবে! এমনটি কি করা হয় বা করা যাবে? করলে কি বেখাপ্পা লাগবে না?
 
কোন কিছুর ক্ষেত্রে অতি উৎসাহ, অতি ভক্তি ও অতি সম্মান দেখানো ঠিক নয়। কথায় আছে, “Excess of anything is bad” (অর্থাৎ “যেকোনো কিছুর অতিরিক্ততা খারাপ”)। আমরা সবকিছুতেই যা আছে তাই বলবো: বাড়িয়েও নয়, কমিয়েও নয়। মেয়রকে “নগর পিতা” আর এমপিকে “মহান সংসদের সদস্য” সম্মোধনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে তাদের চিন্তায়, মননে ও কর্মে পরোক্ষভাবে ও অবচেতন মনে এক অনাকাঙ্খিত ও অযাচিত অহংকার বা অনুভব (Feeling) ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তারা সেবকের পরিবর্তে নিজেকে ভাবতে শুরু করেন অন্য কিছু। আর এ থেকেই আস্তে আস্তে শুরু হয় তাদের মধ্যে একগুঁয়েমিতা, একনায়কত্ব, জবাবদিহীতার ঊর্ধ্বে ভাবার প্রবনতা। এগুলো গণতন্ত্র ও সুষ্ট সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই এইসব উদ্ভট মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিৎ।