চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে দেশের জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর বকেয়া দাবি ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে দেশের ব্যবসা করা ৩৬টি জীবন বীমা কোম্পানিতে বীমা দাবি উত্থাপিত হয় ৫ হাজার ৯৮৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকার। বিপরীতে কোম্পানিগুলো পরিশোধ করেছে ২ হাজার ১০৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর দাবি বকেয়া রয়েছে ৩ হাজার ৮৮০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে। এই সময়ে যে বীমা দাবি উত্থাপিত হয়েছে তার ৬৫ শতাংশ পরিশোধ করেনি জীবন বীমা কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি.। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৯৯ শতাংশ বীমা দাবি বকেয়া পড়ে রয়েছে। বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তৈরি করা প্রতিবেদন থেকে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
বীমা সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের কয়েক কোম্পানি পুরো বীমা খাতের পরিবেশ নষ্ট করছে। এসব কোম্পানি সঠিকভাবে গ্রাহকের দাবির টাকা পরিশোধ করছে না। ফলে বকেয়া বীমা দাবির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। তারা ঠিকমতো গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধ না করায় পুরো সেক্টরে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। যতদিন এসব কোম্পানি গ্রাহকের দাবির টাকা পরিশোধ করতে পারবে না, ততদিন তাদের নতুন পলিসি ইস্যু করতে দেয়া উচিত হবে না।
আইডিআরএ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সার্বিক জীবন বীমা খাতে ৬৫ শতাংশ বীমা দাবি বকেয়া থাকার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে সাতটি কোম্পানি। এর মধ্যে রয়েছে- ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রোগ্রেসিভ লাইফ, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স, গোল্ডেন লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, বায়রা লাইফ এবং সান লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এই কোম্পানিগুলোতে প্রায় সব বীমা দাবি বকেয়া পড়ে রয়েছে। এই সাত কোম্পানিতে বকেয়া বীমা দাবির পরিমাণ তিন হাজার ৫৭১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অর্থাৎ, জীবন বীমা খাতের যে বীমা দাবি বকেয়া আছে তার ৯০ শতাংশের বেশি এই সাত কোম্পানির।
তথ্যে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বীমা দাবি বকেয়া রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। কোম্পানিটিতে দুই হাজার ৮১৫ কোটি এক লাখ টাকার বীমা দাবি উত্থাপিত হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে কোম্পানিটি। বিপরীতে বীমা দাবি বকেয়া রয়েছে ৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। দাবি পরিশোধ না করার হার ৯৮.৯৬ শতাংশ।
এ ছাড়া বায়রা লাইফে দাবি উত্থাপিত হয়েছে ৭৯ কোটি ৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৪০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে পেরেছে কোম্পানিটি। বাকি ৭৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা অপরিশোধিত রয়েছে। পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ২৫৭ কোটি ৪২ লাখ টাকার দাবি উত্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে দুই কোটি ১৪ লাখ টাকা, বকেয়া ২৫৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। হোমল্যান্ড লাইফে উত্থাপিত হওয়া ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকার দাবির মধ্যে ৬৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বিপরীতে বকেয়া ৩৪ কোটি ২১ লাখ টাকা।
গোল্ডেন লাইফে উত্থাপিত হওয়া ৪৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার বীমা দাবির বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি এক কোটি ৬৭ লাখ টাকার দাবি পরিশোধ করেছে। বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ৪১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রোগ্রেসিভ লাইফে উত্থাপিত হওয়া ১৬২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বীমা দাবির মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে ৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, বকেয়া ১৫৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আর সানফ্লাওয়ার লাইফে উত্থাপিত হওয়া ১৯৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা দাবির মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি তিন কোটি ৯৪ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে। বিপরীতে বকেয়া ১৯০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
অপরদিকে, বীমা দাবি পরিশোধের হার সবচেয়ে বেশি আলফা লাইফ, এলআইসি বাংলাদেশ, মার্কেন্টাইল ও সোনালী লাইফের। এই চার কোম্পানি শতভাগ দাবি পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে আলফা লাইফ ১১ কোটি ২৯ লাখ, এলআইসি বাংলাদেশ এক কোটি ২৪ লাখ, মার্কেন্টাইল লাইফ ৪ কোটি ৫ লাখ এবং সোনালী লাইফ ৯৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা বীমা দাবির পুরোটাই পরিশোধ করেছে।
এর পরের অবস্থানে রয়েছে পপুলার লাইফ। কোম্পানিটিতে উত্থাপিত হওয়া ১০৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার মধ্যে ১০২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বিপরীতে বকেয়া রয়েছে দুই কোটি ১৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানটির দাবি পরিশোধের হার ৯৭.৯১ শতংশ।
এ ছাড়া মেটলাইফ বাংলাদেশে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৮৩৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বীমা দাবি উত্থাপিত হয়। এর মধ্যে ৭৬৯ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ করেছে। বিপরীতে বকেয়া রয়েছে ৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। দাবি পরিশোধের হার ৯১.৫৭ শতাংশ।
আইডিআরএ’র মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমি বলেন, যেসব কোম্পানি গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না, এদের মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে। আইডিআরএ বীমা রেজ্যুলেশন অ্যাক্ট-২০২৫ এর খসড়া তৈরি করেছে। সেটা যদি পাস হয়, তাহলে সেই অনুযায়ী গ্রাহকের টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’