Image description

তফসিল ঘোষণার প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলেছে। নির্বাচনী মাঠে নিরাপত্তা নিয়ে যে শঙ্কা ছিল তা কাটাতে দৃশ্যমান কিছু দেখা যাচ্ছে না। বরং তফসিলের পরের দিনই ঢাকার সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টায় নতুন শঙ্কা তৈরি হয়। প্রার্থী এবং ভোটার সবার মধ্যেই এই শঙ্কা রয়েছে। সর্বশেষ গতকাল নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপি’র প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া মাসুদুজ্জামান মাসুদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কারণ দেখিয়ে। নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থী হওয়ার আগেই তার এভাবে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘটনায় নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীর নিরাপত্তা শঙ্কা থেকে সরে দাঁড়ানো নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করা হচ্ছে। ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনার পর আলোচনা হচ্ছে ’২৪-এর পরাজিত শক্তি নানা কায়দায় আবার ফেরার চেষ্টা করছে। তারা নির্বাচন বানচাল করতে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। এমন শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে- খোদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের তরফ থেকেও। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। 

যদিও সরকারের তরফ থেকে প্রার্থীদের নিরাপত্তা প্রটোকল সরবরাহ করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তার ভাষণেও পরাজিত শক্তি ফ্যাসিস্ট টেরোরিস্টদের এই অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতা ও  নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনী প্রচারণায় পরপর দুজন প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় সারা দেশের প্রার্থীদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা চলে গেছে। নিরাপত্তা নিয়ে তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের তরফে বারবার আশ্বাস দেয়া হলেও একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে বড় ধরনের দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই- যে কারণে প্রার্থী ও ভোটাররা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। 

গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে নিরাপত্তার শঙ্কার কথা জানিয়ে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদ। তিনি বলেন, নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকেই পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। ঢাকায় ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনার পর তারা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরিবারের অনুরোধেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বলে জানান তিনি। 
গত ১২ই ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদি। কালভার্ট রোড এলাকায় রিকশাযোগে নির্বাচনী প্রচারণাকালে হাদিকে গুলি করেন চলন্ত মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থাকা আঁততায়ী। গুলিটি লাগে হাদির মাথায়। গুরুতর আহত হাদিকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে সোমবার তাকে নেয়া হয় সিঙ্গাপুরে। এ ঘটনার পরপর নিরাপত্তা শঙ্কায় নির্বাচন প্রচারণা স্থগিত ঘোষণা করেন ঢাকা-৯ আসনের এনসিপি মনোনীত প্রার্থী ও দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক ডা. তাসনিম জারা। ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তি ফয়সাল করিম মাসুদ সাবেক ছাত্রলীগের নেতা এবং পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে তথ্য এসেছে। 

পলাতক নেতাদের পরিকল্পনায় এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এমন অবস্থায় নির্বাচনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক দলের পক্ষ থেকেই শঙ্কা প্রকাশ করে তাদের নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানানো হয়। এই দাবির প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলের নেতা ও নির্বাচনের প্রার্থীদের জন্য নিরাপত্তা দিতে পুলিশ প্রটোকল সরবরাহ করার ঘোষণা দেয়া হয়।

গতকাল জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর পর জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সরকার ও পুলিশের ওপর নির্ভর করে জুলাইযোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন এনসিপি’র এই নেতা। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, ৫ই আগস্টের পরবর্তী সময়ে আমাদের নিরাপত্তা আমরা নিজেরাই নিশ্চিত করেছিলাম যখন কোনো সরকার ছিল না, পুলিশ ছিল না। বাংলাদেশ সেই পরিস্থিতির দিকেই যাচ্ছে। 
গত ৫ই নভেম্বর নির্বাচনী জনসংযোগে চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও চান্দগাঁও) আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

ওদিকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্যে যারা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন, তাদের গানম্যান ও বডিগার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে তাদের গানম্যান দেয়া হবে। আর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ইউনিফর্মধারী বডিগার্ডের ব্যবস্থা করবে। প্রার্থী ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তি ঝুঁকিতে আছেন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারাও একই ধরনের সুবিধা পাবেন। নির্বাচন পর্যন্ত তাদের জন্য এমন নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। 

সর্বশেষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়, সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সামনে রেখে পুলিশের তরফে সব রাজনৈতিক দলের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল সরবরাহ করা হবে। এই প্রটোকলে রাজনৈতিক নেতা এবং আসছে নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের বাসস্থান, কার্যালয়, চলাচল, জনসভা ও সাইবার স্পেসে কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন- সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হবে। গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির নেতৃত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের বাড়তি নিরাপত্তা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 
নিরাপত্তা জোরদারে সারা দেশে অপারেশন ডেভিল হান্টের দ্বিতীয় পর্যায় চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। পুলিশ সূত্র জানায়, অবৈধ ও লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে জোর দেয়া হচ্ছে এই অভিযানে।