কথায় আছে ‘মর্নিং সোজ দা ডে’। সকালের সূর্য দেখেই বোঝা যায় দিনটা কেমন কাটবে। এবারের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে, প্রার্থীরা আচরণবিধি মানতে কতটা বাধ্য করতে পারবেন নির্বাচন কমিশন সে বার্তা দেয়ার সময় এখনই। তফসিল ঘোষণার পরই আচরণবিধি লংঘনের হিড়িক পড়ে গেছে। বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের অবৈধ ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, তোরণে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের প্রধান সড়ক, অলিগলি, সরকারি ভবনের দেয়াল, বিদ্যুতের খুঁটি, সেতুর রেলিং ভরে গেছে। নির্বাচন কমিশন এখনই এসব অবৈধ পোস্টার তুলে ফেলতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের বাধ্য করতে আইন প্রয়োগে কতটুকু কঠোর হন তার উপর নির্ভর করবে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ। নির্বাচন কমিশন এখন নরম হলেই নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের মধ্যে আচরণ বিধি লংঘনের প্রতিযোগিতা হবে।
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ভোটারদের প্রত্যাশা নিরপেক্ষ নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘ইতিহাসের সেরা নির্বাচন উপহার দেয়া হবে’ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে এবং প্রার্থীদের আচরণবিধি মানতে বাধ্য করতে ইসির আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের এখনই সময়। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটে প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলতে বাধ্য করতে এখনই কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রার্থীদের আচরণবিধি বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশন এখনই ঢিলেমি করলে নিরপেক্ষ নির্বাচন করাই চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশজুড়ে আচরণবিধি কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। নির্বাচন কমিশনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, তোরণ ও প্রচারসামগ্রী সরিয়ে নেয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ এলাকায় তা মানা হচ্ছে না।
প্রধান সড়ক, অলিগলি, সরকারি ভবনের দেয়াল, বিদ্যুতের খুঁটি, সেতুর রেলিং এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফটকেও ঝুলে থাকতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ও প্রার্থীদের ব্যানার-পোস্টার। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের এই প্রবণতা শুধু নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং প্রশাসনের কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। তবে প্রশ্ন উঠছে এই অভিযান কি পর্যাপ্ত? দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, আমাদের লোকবল সীমিত। একদিকে আইনশৃঙ্খলা, অন্যদিকে নির্বাচন। সবকিছু একসঙ্গে সামলানো কঠিন। তবে অনেকেই বলছেন, এটি কেবল জনবল সংকটের অজুহাত। রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাবের কারণেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। নির্বাচনী পোস্টার ও ব্যানারে শহরের সৌন্দর্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, প্লাস্টিক ও পলিথিনজাত পোস্টার পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
নির্বাচন কেবল ভোট দেয়ার দিনেই সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রস্তুতিপর্ব থেকেই সুশাসনের পরীক্ষাও শুরু হয়। ব্যানার-পোস্টার সরানোর মতো একটি মৌলিক নির্দেশনা যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে নির্বাচন কতটা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবেÑসে প্রশ্ন থেকেই যায়। নির্বাচনী আচরণবিধি মানা শুধু আইনগত বাধ্যবাধকতা নয়, এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিরও অংশ। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন কতটা দৃঢ়তার সঙ্গে এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে এমনটাই জানালেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে সারাদেশে পোস্টার, ব্যানার অপসারণের নির্দেশনা দেয়া হয়। তফসিল ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড অপসারণের নির্দেশ দিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি দেন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন। চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, দেয়াললিখন, বিলবোর্ড, গেট, তোরণ বা ঘের, প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জাসহ সব ধরনের প্রচারসামগ্রী এবং নির্বাচনী ক্যাম্প তফসিল ঘোষণার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিজ খরচে ও দায়িত্বে অপসারণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনার কথাও বলা হয়।
ইসি বলছে, নির্দেশনা না মানলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা ব্যবস্থা নেবেন। নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালনে দেশের ১০ প্রশাসনিক অঞ্চলে ১০ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গত শনিবার ইসির সহকারী সচিব মোহাম্মদ শহীদুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি পরিপত্রে বলা হয়েছে, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী ফলাফল গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত সময়ের জন্য ১০ জন কর্মকর্তাকে ১০ অঞ্চলের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে বলা হয়েছে। ১০ কর্মকর্তা যে দায়িত্ব পালন করবেন সেগুলো হলো- ভোটকেন্দ্র সম্পর্কিত পাওয়া অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য উপস্থাপন; নির্বাচনকালীন আচরণ-বিধি ভঙ্গ ও অন্যান্য অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য নথি উপস্থাপন; নির্বাচন উপলক্ষে পঠিত বিভিন্ন কমিটির কাছ থেকে প্রতিবেদন সংগ্রহ ও মাননীয় নির্বাচন কমিশন সমীপে উপস্থাপন; মনোনয়নপত্র দাখিল হতে বার্তাশিট সংগ্রহসহ রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ; প্রতীক বরাদ্দের পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তালিকা সংগ্রহ এবং তালিকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নাম বাংলা বর্ণমালার ক্রমানুসারে হয়েছে কিনা তা যাচাই।
এছাড়াও ব্যালট পেপার মুদ্রণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তালিকা মুদ্রণালয়ে পাঠানো; ব্যালট পেপার মুদ্রণের প্রুফ রিডিং এবং চূড়ান্ত মুদ্রণের জন্য অনুমোদন দেওয়া; ভোটগ্রহণের দিন পরিস্থিতি প্রতিবেদন সংগ্রহ ও নির্বাচন কমিশন সমীপে উপস্থাপন; বেসরকারি ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন এবং ওসিভিও আইসিভি বিষয়ক দায়িত্ব পালন। এ চিঠিতে আরও বলা হয়, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক, আইন অনুবিভাগের যুগ্মসচিব ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনা-২ শাখা অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া ও সমন্বয় করবেন। অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক সরবরাহ করা মনোনয়নপত্র দাখিল, বাছাই, আপিল গ্রহণ, আপিল নিষ্পত্তি, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তথ্য একীভূত করে নির্বাচন কমিশনে উপস্থাপন করবেন। এছাড়া ভোটগ্রহণের দিন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া ফলাফল (বার্তাশিট) এবং পরিস্থিতি প্রতিবেদন সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য একীভূত ও নির্বাচন কমিশনে উপস্থাপনসহ এ সংক্রান্ত সব কার্যক্রম নেবেন। তাছাড়া জরুরি প্রয়োজনে অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক নথি উপস্থাপন ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরামর্শ দেবেন। সারাদেশে নির্বাচন পূর্ব অনিয়ম অনুসন্ধানে নির্বাচনী অনুসন্ধান ও বিচারিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও ইসির নির্দেশনা না মানলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
সারাদেশে বিচারবিভাগের সমন্বয়ে ৩০০ আসনে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গত রোববার ইসি সচিবালয় থেকে প্রজ্ঞাপনা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটে ৩০০ আসনে নির্বাচন-পূর্ব অনিয়ম অনুসন্ধান করার পাশাপাশি নির্বাচনে অপরাধ সমূহের সংক্ষিপ্ত বিচারের জন্য দায়িত্বপালনের উদ্দেশ্যে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৩০০ আসনে নির্বাচনী অনুসন্ধান ও বিচারিক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, তফসিল ঘোষণার পর নির্দেশনা অনুযায়ী ২৪ ঘন্টার মধ্যে পোস্টার, ব্যানার প্রচারসামগ্রী অপসারণ করতে হয়েছে। অন্যথায় নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকায় বসবাসকারী বাসিন্দারা জানান, তফসিল ঘোষণার পর পোস্টার নামানোর নির্দেশনা থাকলেও তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। নতুন করে অনেক জায়গায় পোস্টার লাগানো হচ্ছে। সবাই জানে পোস্টার লাগানো নিষেধ, কিন্তু কে শোনে কার কথা? প্রশাসনও যেন চোখ বন্ধ করে থাকে। সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। আইন যদি সবার জন্য সমান না হয়, তাহলে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
তারা আরো বলেন, নির্বাচন শেষ হলে এই পোস্টারগুলো ডাস্টবিনে না গিয়ে ড্রেন ও খালে জমে। এতে পানিবদ্ধতা ও পরিবেশ দূষণ বাড়ে। আমাদের দেয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ, কিন্তু রাজনৈতিক পোস্টার কেউ সরায় না। আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ খুবই সীমিত। অতীতে কিছু জরিমানা ও সতর্কবার্তা দেয়া হলেও বড় কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি খুব কমই দেখা গেছে। যতদিন পর্যন্ত কয়েকটি কঠোর দৃষ্টান্ত তৈরি না হবে, ততদিন আচরণবিধি মানার প্রবণতা বাড়বে না। নির্বাচন কমিশনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো সমান মাঠ নিশ্চিত করা। কিন্তু পোস্টার-ব্যানার ইস্যুতে দুর্বলতা কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো ঘুরে দেখা যায়, নির্বাচন উপলক্ষে ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে পুরো ঢাকাসহ সারাদেশ। কোথাও বিশাল আকারের বিলবোর্ড, কোথাও রঙিন পোস্টারে ভরা দেয়াল। দেয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ এমন নির্দেশনা যেন কারো জানাই নেই। শুধু দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো নয় এখন ঢাকা যেন পোস্টার, ব্যানার-ফেস্টুনের অপরিচ্ছন্ন নগরী। সড়ক, মহাসড়ক-অলিগলি সব খানেই ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টার। মেট্রোরেলের পিলার, ফ্লাইওভারের পিলার, ভবন, ফুটওভারব্রিজ, ট্রাফিক পুলিশ বক্স, যাত্রীছাউনি, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে সাঁটানো হয়েছে বিভিন্ন সাইজের ব্যানার-ফেস্টুন। দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে ছোট ছোট দলগুলোও নেমেছেন ব্যানার-ফেস্টুন টানানোর প্রতিযোগিতায়। নগরজুড়ে ভবন, পিলার রাস্তা-ঘাটে এসব ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টার অপসারণের সাহসই পাচ্ছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় ভবন, দেয়াল, পিলারসহ সবখানে নির্বাচনী পোস্টার লাগালেও তারা এখন গাছে-গাছে, পাতায়-পাতায় এমনকি ডিশের তারেও পোস্টার-ব্যানার লাগাতে ব্যস্ত।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা রাসেল রহমান জানান, যত্রতত্র দেয়াল লিখন, পোস্টার, ব্যানার, বিজ্ঞাপন, ফেস্টুন, বিলবোর্ড, নোটিশ, প্ল্যাকার্ড লাগানোর ফলে নগরীর সৌন্দর্য মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। সেই কারণে ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সব অননুমোদিত দেয়াল লিখন, পোস্টার, ব্যানার, বিজ্ঞাপন, ফেস্টুন, বিলবোর্ড, নোটিশ অপসারণ করা হবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্বাচনী ব্যানার-পোস্টার অপসারণের নির্দেশনা দিয়েছে সংস্থাটি। ডিএনসিসির সচিব মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান এই বিষয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করে এই নির্দেশনা দেন। অফিস আদেশে ডিএনসিসির সচিব মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান উল্লেখ করেন, ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতাধীন সব সম্ভাব্য প্রার্থীর পোস্টার, ব্যানার, দেয়াল লিখন, বিলবোর্ড, গেট, তোরণ বা ঘের, প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জা ইত্যাদি প্রচার সামগ্রী ও নির্বাচনী ক্যাম্প থাকলে তা অপসারণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হলো।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, প্রধান সড়ক, রাজপথ এবং গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে এ বিপুল সংখ্যক ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টার অপসারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন অলিগলিতে ব্যানার ফেস্টুনের পরিমাণ বেশি। অপসারণ করা ব্যানার ফেস্টুনের ২৮ শতাংশ রাজনৈতিক। পরিবর্তনের অংশীদার হিসেবে আশা করি কেউ আর এভাবে শহর নোংরা করবেন না। এ ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এ ধরনের অবৈধ প্রচারণা থেকে বিরত থাকবেন।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার পরও চট্টগ্রামে সরেনি সম্ভাব্য প্রার্থীদের রঙ্গিন পোস্টার, ব্যানার, বিলবোড। গতকাল সোমবারও নগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সংখ্যক নির্বাচনি প্রচারসামগ্রী শোভা পেতে দেখা যায়। নগরীর প্রায় প্রতিটি দেয়ালে শোভা পাচ্ছে রঙ্গিন পোস্টার। ঝুলছে প্রার্থীর ছবি ও মার্কাসহ ডাউস ব্যানার। নগরীর পতেঙ্গা, আগ্রাবাদ, চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামি আন্দোলনসহ বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচার ব্যানার, পোস্টার থেকে গেছে। গত বৃহস্পতিবার তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচার সামগ্রী নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নিতে বলা হয়। পরদিন কোন কোন প্রার্থী নিজ উদ্যোগে কিছু ব্যানার, পোস্টার সরিয়ে নেয়। তবে বেশিরভাগ ব্যানার, পোস্টার সরেনি এখনো। এদিকে সংসদ নির্বাচনে আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় নগর ও উপজেলায় ৪২ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত তাদের তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায়নি।
দিনাজপুর অফিস জানায়, দীর্ঘ প্রত্যাশিত জাতীয় ও গণভোট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার চার দিন অতিবাহিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক তফশিল ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পূর্বে লাগানো সকল ধরনের পোস্টার-ফেষ্টুন ব্যানার নিজেদের উদ্যোগে সরিয়ে জন্য বলা হয়েছিল। দিনাজপুর অঞ্চলের তিনটি জেলা পঞ্চগড় ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলার ১১ টি আসনে নির্বাচনি আমেজ সৃষ্টি হলেও দিনাজপুরের কন্যা দেশনেত্রী বেগম খালেজা জিয়ার অসুস্থতাজনিত কারণে নির্বাচনী প্রচারণাগুলি কার্যত ভারাক্রান্ত সভায় পরিণত হয়েছে। তবে তফশিলের আগে লাগানো পোষ্টার ব্যানার ফেষ্টুন নিজেদের উদ্যোগে সরানোর কোন লক্ষন চোখে পড়ছে। দিনাজপুর সদরে ভোট ও দোয়া চেয়ে লাগানো পোষ্টার ও ফেষ্টুন না সরানোর কথা জিঙ্গেস করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিএনপি নেতা জানালেন, তৈরী ও লাগাতে খরচ হয়েছে মনোনয়ন পাইনি। এখন আর নিজেদের উদ্যোগে এসব সরাতে আর খরচ করে কি লাভ। বরং যে কয়দিন আছে তাতে কিছুটা হলেও জনগনের চোখেতো থাকছি। প্রশাসন যখন মনে করবে তখন সরিয়ে নিবে।
খুলনা ব্যুরো জানায়, বৃহত্তর খুলনায় পোস্টার, প্যানা ও বিল বোর্ড অপসারণে প্রার্থীদের শৈথিল্যতায় অবশেষে মাঠে নেমেছে প্রশাসন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ক্লিন হয়নি খুলনার নির্বাচনী মাঠ চিত্র। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পোস্টার, প্যানা ও বিল বোর্ড অপসারণে নির্দেশ দিলেও সাড়া মেলেনি অধিকাংশ জায়গায়। জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে সর্বত্র মাইকিং করা হয় ৭২ ঘন্টা আগে। কিন্তু নির্বাচনী মাঠের চিত্র ভিন্ন। দুই এক জায়গায় নিজ থেকে কিছু প্যান বোর্ড খুলে ফেলা হলেও রং বেরঙের বাহারী প্যান ফেষ্টুন জল জল করছে। খুলনা সিটি কর্পোরেশন দু’দিনের মধ্যে এগুলো অপসারন করবে বলে সংশ্লিস্ট নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করেছেন।
কেসিসি ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত রোববার দিনব্যাপী নগরীতে বিদ্যমান সকল নির্বাচনী প্রচারণা সামগ্রীসহ প্যানা-ফেস্টুন অপসারণ করা হয় বলে খুুলনা সিটি কর্পোরেশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত অপসারণ হয়নি বলে নাগরিকদের অভিযোগ। প্রধান প্রধান সড়কে প্যান ফেস্টুন অপসারণ হলেও পাড়া মহল্লার অলিতে গলিতে ঝুলছে এখনও নির্বাচনী প্যানা। অপরদিকে খুলনা জেলার ৯টি উপজেলা সদরে সহকারী কমিশনারগনের নেতৃত্বে বড় বড় বিল বোর্ড অপসারণ হলেও উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের চিত্র ভিন্ন। প্রত্যেক ইউনিয়নের সকল ওয়ার্ডে বিএনপি, জামায়াত ইসলাম, চরমোনাই এবং স্বতন্ত্রসহ বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের ছবি সম্বলিত রঙিন পোষ্টার, প্যান বিল বোর্ড এখনও গাছে গাছে মোড়ে মোড়ে ঝুলছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জেলা প্রশাসন কাউকে নোটিশ বা জরিমান করেনি। অপরদিকে নগরীর শান্তিধাম মোড়ে, ডাকবাংলো মোড়ে বিশাল বড় প্যানা টানানো রয়েছে বিভিন্ন দলের প্রার্থীর। শুধু এসব এলাকা নয়, নগর জুড়ে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এসব প্রার্থীদের বড় বড় প্যানা ও বিল বোর্ড।
বটিয়াঘাটার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইভান ইনকিলাবকে জানান, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী বটিয়াঘাটা উপজেলার গল্লামারী ব্রিজ হতে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত, জিরো পয়েন্ট হতে যশোর রোডে বটিয়াঘাটা উপজেলার সীমানা পর্যন্ত রাস্তার দুইধারের, কৈয়া বাজার পর্যন্ত রাস্তার দুইধারের প্রচরণাসামগ্রী অপরসারণ করেছি।
খুলনা জেলা প্রশাসক আ স ম জামসেদ খোন্দকার বলেন, সকলকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নগরীতে রোববার বিকেল থেকে অভিযান শুরু হয়েছে। জেলার ৪টি সংসদীয় আসনেও অভিযান অব্যাহত থাকবে।
সিলেট ব্যুরো জানায়, নেই সিলেটে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড। অপসারন করা হয়েছে সিলেটের সর্বত্র। প্রার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে অপসারণ না করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পুরোদমে সেই কাজ বাস্তবায়ন করেছেন। নগরীর ওয়ার্ডে ্ওয়ার্ডে ঘোষণা দিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা অপসারণ নামেন ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ডগুলো। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনা অনুযায়ী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শুরু হয় সব প্রচার উপকরণ অপসারণ। এতে নগরী সহ প্রত্যন্ত এলাকায় প্রকাশ পেয়েছে এক ভিন্ন পরিচ্ছন্ন চিত্র। নগরীর বিভিন্ন সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান, বিভিন্ন এলাকার বিদ্যুতের খুঁটি, পিলার ও বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে সারি সারি ঝুলানো ছিল বাহারী কালারে নজর কাড়া পোস্টার ও ব্যানার।
এবিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সিলেটের জেলা প্রশাসক সারওয়ার আলম বলেন, অনেক প্রার্থী ইতোমধ্যে আচরণবিধি মেনে তাদের প্রচারণাসামগ্রী অপসারণ করেছেন। যেগুলো অপসারণ হয়নি, সেগুলো সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় দ্রুত সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
সাদিক মামুন, কুমিল্লা থেকে জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুই দিন পর কুমিল্লায় সম্ভাব্য ও দলীয় ঘোষিত প্রার্থীদের নির্বাচনী পোস্টার ও ব্যানার অপসারণ কার্যক্রম চলছে। দ্বিতীয় দিনের মতো গতকাল সোমবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ও উপজেলা প্রশাসন যৌথভাবে এ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানকালে নগরীর বিভিন্ন অলিগলি এবং উপজেলার সড়ক-মহাসড়ক, বিদ্যুতের খুঁটি, হাট–বাজার, দেয়াল ও বিলবোর্ড থেকে পোস্টার ও ব্যানার অপসারণ করা হয়।
নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার পর নির্ধারিত নির্দেশনা অনুসারে প্রার্থীদের নিজ উদ্যোগে পোস্টার ও ব্যানার অপসারণ করার কথা থাকলেও নগরী ও উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এখনো প্রচারসামগ্রী দেখা যাওয়ায় দ্বিতীয় দিনের মতো এ অভিযান চালানো হয়। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নির্বাচনী আচরণবিধি বাস্তবায়ন এবং নগরীর সৌন্দর্য রক্ষায় পোস্টার–ব্যানার অপসারণ অভিযান অব্যাহত থাকবে। নির্দেশনা অমান্য করে কেউ পোস্টার বা ব্যানার ঝুলিয়ে রাখলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. রেজাউল হাসান জানান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের উপস্থিতিতে কুমিল্লা নগরীসহ জেলার ১১টি সংসদীয় আসনে পোস্টার–ব্যানার অপসারণের কাজ শুরু করা হয়েছে। নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করতে ১১টি আসনেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে রয়েছেন। নির্ধারিত সময় ও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার আবিদা আল আকসার আশা বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব ধরনের নির্বাচনী প্রচারসামগ্রী অপসারণ নিশ্চিত করা হচ্ছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
রায়গঞ্জ (সিরাজগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ড অপসারণে ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা শেষে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছে রায়গঞ্জ উপজেলা প্রশাসন। গতকাল সোমবার ধানগড়া, রায়গঞ্জ, ভুঁইয়াগাতি, নিমগাছীসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পরিদর্শনে যান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদ রানা। এ সময় বিভিন্ন স্থানে থাকা অবৈধ রাজনৈতিক ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করা হয়। অভিযানে রায়গঞ্জ পৌরসভা ও রায়গঞ্জ থানা সহযোগিতা করে। উপজেলা প্রশাসন জানায়, উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বাজার ও জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে সব ধরনের ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ড অপসারণ করে এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হবে।