ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরের দিনই ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। সংকটাপন্ন অবস্থায় গতকাল সোমবার তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছে। হাদিকে গুলির ঘটনার পর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি এবং প্রার্থীদের গানম্যান ও দেহরক্ষী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি এসব ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় একজন করে বেসরকারি সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়োগ দিতে পারবেন। এ ছাড়া সীমিত সময়ের জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সও নিতে পারবেন। এ ব্যাপারে গতকাল সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের অনুকূলে ‘আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ও রিটেইনার নিয়োগ নীতিমালা, ২০২৫’ জারি করেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়োগ এবং আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিতে নিরাপত্তাঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি ও প্রার্থীদের নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিরাপত্তাঝুঁকির মাত্রা এবং ব্যক্তি সম্পর্কে তদন্তের পর আবেদন অনুমোদন করা হবে। আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রে এতদিন শুধু সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের অনুকূলে ইস্যু করা হতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ আগস্ট রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনে বিগত ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত যেসব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বেসামরিক জনগণকে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো স্থগিত করে। একই সঙ্গে তাদেরকে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। এরপর অস্ত্র জমা নেওয়া শুরু হয়। কারও কারও নিরাপত্তাঝুঁকি বিবেচনায় জমা নেওয়া সেই অস্ত্র ফেরত দেওয়ারও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে এ ক্ষেত্রে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের কেউ অস্ত্র ফেরত পাবেন না।
সূত্র জানায়, নিরাপত্তাঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এরই মধ্যে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে প্রায় ৫০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে তাঁদের গানম্যান দেওয়া হবে। এ ছাড়া ইউনিফর্মধারী বডিগার্ডের ব্যবস্থাও করা হবে। নির্বাচন পর্যন্ত তাঁদের জন্য এটি বহাল থাকবে। রাজনৈতিক ব্যক্তি, সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীরা ছাড়াও ছাত্রনেতা, জুলাই যোদ্ধা, শিক্ষকসহ আরও বেশকিছু শ্রেণির ব্যক্তি এ নিরাপত্তা পাবেন। এরই মধ্যে তাঁদের ঝুঁকির মাত্রা বিশ্লেষণের কাজ শুরু হয়েছে।
জানতে চাইলে আইজপি বাহারুল আলম গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, ‘ঝুঁকি বিবেচনায় ইতোমধ্যে আমরা নিরাপত্তা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। কারও কারও বাসা বাড়িতেও নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’ কোন কোন শ্রেণির ব্যক্তিরা এই নিরাপত্তা পাবেনÑ জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, ‘যাঁর নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে, তাঁকেই আমরা নিরাপত্তা দেব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশের যে বাস্তবতাÑ বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আলোকে আমরা অনেক কথা বলি,
দল বা প্রার্থীরা অনেক কথা বলেন। কিন্তু নির্বাচনীমূলক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে একটা বড় অংশই আচরণবিধি বা গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের পরিবর্তে পেশীশক্তি ব্যবহার করে যে কোনো উপায়ে জয়ী হতে চান। এই প্রবণতাগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্যই বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া কিংবা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অতীতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি। আমরা চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে ব্যবস্থা নেবে। পাশাপাশি সবার জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আবার একজন প্রার্থীকে তাঁর নিরাপত্তার প্রশ্নে বৈধ অস্ত্র বহনের লাইসেন্স দেওয়া হলো, এ সিদ্ধান্তের ইতিবাচক দিক রয়েছে। তবে এগুলো যেন কোনোভাবে অগণতান্ত্রিকভাবে ব্যবহার না করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আবার প্রার্থীদের পাশাপাশি ভোটারের নিরাপত্তায়ও ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জননিরাপত্তা নিশ্চিত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচনকালীন সহিংসতা প্রতিরোধে রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের অনুকূলে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ও রিটেইনার নিয়োগের জন্য গতকাল নীতিমালা জারি করা হয়। এর আওতায় অনুমোদনকৃত লাইসেন্সের মেয়াদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ হতে পরবর্তী ১৫ দিন হবে। উক্ত সময়ের পর এইরূপ লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে। তবে শর্ত থাকে যে, লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য জারিকৃত নীতিমালার অন্যান্য শর্ত পূরণ হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সাময়িক লাইসেন্সকে সাধারণ লাইসেন্সে রূপান্তর করতে পারবে; লাইসেন্সের মেয়াদ অতিক্রান্ত হলে কোনো লাইসেন্সধারী উক্ত লাইসেন্সের বিপরীতে আগ্নেয়াস্ত্র নিজ দখলে রাখলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন মোতাবেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, কেবল প্রকৃত নিরাপত্তাঝুঁকি থাকলে রিটেইনার (সশস্ত্র দেহরক্ষী) নিয়োগ অনুমোদনযোগ্য হবে; রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে কিংবা ভয়ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে রিটেইনার নিয়োগ করা বা অনুমোদন করা যাবে না; কোনো রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা পদপ্রার্থী লাইসেন্স প্রাপ্তির যোগ্য হলে এবং তিনি আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয়ে অসমর্থ বা অনিচ্ছুক হলে বৈধ লাইসেন্সসহ আগ্নেয়াস্ত্র আছে, তা পরিচালনায় সক্ষম এবং কোন রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা পদপ্রার্থীর রিটেইনার হতে ইচ্ছুকÑ এমন কোনো ব্যক্তিকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ রিটেইনার নিয়োগ করতে পারবেন।
রিটেইনারের যোগ্যতা ও নিয়োগ পদ্ধতি
ব্যক্তি অপরাধমুক্ত ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স প্রাপ্ত, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত (সশস্ত্র বাহিনী বা বাংলাদেশ পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত সদস্যগণ অগ্রাধিকার পাবেন) এবং সরকারি হাসপাতাল থেকে তাঁদের মেডিক্যাল ফিটনেস সনদপ্রাপ্ত হতে হবে। একজন রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা পদপ্রার্থীর জন্য সর্বোচ্চ একজন রিটেইনার নিয়োগযোগ্য হবে। রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা পদপ্রার্থী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নির্ধারিত ফরমে আবেদন দাখিল করতে হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ২ (দুই) কর্মদিবসের মধ্যে প্রাথমিক যাচাই সম্পন্ন করবেন, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার নিরাপত্তা যাচাই তিন কর্মদিবসের মধ্যে সম্পন্ন হতে হবে। সকল প্রতিবেদন সন্তোষজনক হলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অবিলম্বে রিটেইনার লাইসেন্স অনুমোদন প্রদান করবেন।
অস্ত্র ব্যবস্থাপনা
রিটেইনারের অনুকূলে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ইস্যু করা হবে না। রিটেইনার কেবল আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী হবেন, অস্ত্র-সংক্রান্ত সব দায় লাইসেন্সধারীর ওপর বর্তাবে। অস্ত্র বহনকালে সর্বদা লাইসেন্স এবং অনুমোদন সঙ্গে রাখতে হবে। এই অস্ত্র ব্যবহার করে কাউকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা হয়রানি করা যাবে না। নিরাপত্তা ব্যতীত অন্য কোনো কাজে বা উদ্দেশ্যে এই লাইসেন্সের আওতাভুক্ত অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
তদারকি ও বাতিল
অপব্যবহার বা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনে বা সরকারের অন্য কোনো বিধিবিধান ও নিয়ম লঙ্ঘন করলে লাইসেন্স ও রিটেইনার অনুমোদন কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ/অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ উক্ত লাইসেন্স বা অনুমোদন তাৎক্ষণিক বাতিল করতে পারবে।
লাইসেন্স প্রাপ্তির যোগ্যতা
সরকার কর্তৃক স্বীকৃত রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হতে হবে ; ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করতে হবে; উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা) কর্তৃক যাচাইকৃত নিরাপত্তাঝুঁকি বিদ্যমান থাকতে হবে; শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা থাকতে হবে; অস্ত্র সংরক্ষণের নিরাপদ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই নীতিমালার অধীনে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে এই সংক্রান্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত অন্যান্য নীতিমালা ও বিধান প্রযোজ্য হবে। তবে ব্যক্তিগত আয়কর প্রদান-সংক্রান্ত অংশ শিথিলযোগ্য হবে।
সীমাবদ্ধতা
শুধু আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে সীমিত ক্যালিবারের (এনপিবি ) অস্ত্র; একাধিক অস্ত্রের লাইসেন্স অনুমোদিত হবে না; স্বয়ংক্রিয় বা সামরিক অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান যোগ্য হবে না।
নির্বাচনকালীন বিধান
এই নীতিমালা ইসি ঘোষিত আচরণবিধির পরিপূরক হবে এবং কোনোক্রমেই উক্ত আচরণবিধি/বিধিসমূহের ব্যত্যয়ে ব্যবহৃত হইবে না; নির্বাচন কমিশন ঘোষিত আচরণবিধি লঙ্ঘন স্বতন্ত্র অপরাধ বলিয়া গণ্য হবে। লাইসেন্স বা রিটেইনার নিয়োগ বাতিল/স্থগিতের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আপিল করা যাইবে।