Image description
পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথ পুনর্বাসন

সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় নির্ধারিত খরচের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয়ে দেওয়া হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাব। শুধু প্রকল্পের মোট ব্যয়ই নয়, অঙ্গভিত্তিক ব্যয়ের ক্ষেত্রেও এমন খরচ ধরা হয়েছে। ফলে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। পাশাপাশি বিষয়টি খতিয়ে দেখতে প্রস্তাব ফেরত দেওয়া হচ্ছে। ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসন (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পে এ ঘটনা ঘটছে। এটি নিয়ে ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। সেখানেই প্রশ্নের মুখে পড়েন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা রোববার যুগান্তরকে বলেন, পঞ্চিমাঞ্চলের রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্প চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে নির্ধারিত গতি ও নিরাপদ ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এছাড়া যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ সেবার মান বাড়বে। এজন্য প্রকল্পটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে বেশি ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলেন, যখন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছিল তখন অন্য রেটের শিডিউল ছিল। আর যখন প্রকল্প তৈরি করা হয় তখন নতুন রেটের শিডিউল ধরায় এমন হয়েছে। তবে যেসব খাতে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে সেসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি রেলপথ মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে কোনোভাবেই যাতে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা না হয়। প্রস্তাবিত ব্যয়গুলো পুনরায় পর্যালোচনা করতে প্রস্তাবটি ফেরত দেওয়া হচ্ছে।

রেলপথে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ১১৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা। সম্পূর্ণ সরকারের অর্থায়নে এটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০৩০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এটি রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া রংপুর বিভাগের দিনাজপুর ও নীলফামারী এবং খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া জেলার ১৭টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হবে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে ট্র্যাক ওয়ার্কস খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৮০৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকল্প প্রস্তাবে একই খাতে ধরা হয়েছে এক হাজার ৮২৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে বাড়তি ধরা হয়েছে ১৮ কোটি টাকা। এছাড়া ওই সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকল্পের মোট ব্যয়ের সুপারিশ ছিল দুই হাজার ৪৫ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ধরা হয়েছে দুই হাজার ১১৯ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত ধরা হয়েছে ৭৪ কোটি টাকা। প্রকল্পে ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সিতে ৩৯ কোটি ৬১ লাখ এবং প্রাইস কন্টিনজেন্সি খাতে ৯৯ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। এই দুই খাতেও বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন। পাশাপাশি একই রেট শিডিউল (২০২১) অনুসরণ করে প্রকল্প তৈরি করা হলেও সমজাতীয় অন্য চলমান প্রকল্পের তুলনায় কংক্রিট স্লিপার খাতে বেশি ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবে একটি অতিরিক্ত ব্লাস্ট টেম্পারিং মেশিন কেনার সংস্থানও রয়েছে। এসব ব্যয়ের ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা, ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তিসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয় পিইসি সভায়।

আরও যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয় সেগুলো হলো-প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অতিরিক্ত দায়িত্বে এবং ৭ জন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে পদায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান পরিপত্র অনুযায়ী জনবলের পদ, ধরন ও সংখ্যা নির্ধারণে অর্থ বিভাগের জনবল নির্ধারণ কমিটির সুপারিশ প্রয়োজন হলেও তা নেওয়া হয়নি। এছাড়া বিদ্যমান পরিপত্রে ৫০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে প্রকল্পের ক্ষেত্রে পূর্ণকালীন অভিজ্ঞ ও যোগ্য প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের বিষয়টি অবশ্যই পরিপালন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এত বৃহদাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের কথা বলা হয়নি। ফলে প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে এক হাজার ৯৩০ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার রেলপথ ও দুই হাজার ৫০৫ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ট্র্যাক রয়েছে। এর মাধ্যমে যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকা পর্যন্ত নিয়মিত চলাচল করে। প্রকল্পভুক্ত সেকশনগুলোর অনেকাংশে ১৯৩০, ১৯৪৩, ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালের পুরোনো রেল দিয়ে তৈরি। এসব রেলের ক্ষয়ের হার ১২-১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দিন দিন আরও বাড়ছে। ফলে প্রতিনিয়ত রেলপথে ফাটল, ওয়েলডিং জয়েন্ট খুলে যাওয়া এবং রেল ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। রেলপথের এরকম ত্রুটির কারণে নিরাপদ ট্রেন চলাচল মারাত্মক হমকির মুখে পড়েছে। উল্লেখিত সেকশনগুলোতে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ অকেজো বা ভাঙা স্লিপার আছে। দিন দিন এর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রায় সব সেকশনে ব্যালাস্টের তীব্র ঘাটতি রয়েছে। এতে ট্র্যাকের ভারসাম্য, গেজ, অ্যালাইনমেন্ট রক্ষা করা যাচ্ছে না।

প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম হলো-ভবানীপুর হতে এমজিএমসিএল পর্যন্ত ২১ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসন করা হবে। এছাড়া ৫৫০ কিলোমিটার নৈমিত্তিক সংস্কার, ৪৩ দশমিক ৯০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ ট্র্যাক সংস্কার এবং ৫৬ দশমিক ৩০ কিলোমিটার রেল পরিবর্তন হবে।