নির্বাচন সামনে রেখে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে সামষ্টিক অর্থনীতি আরও বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। হুমকির মুখে পড়বে মানুষের জীবন-জীবিকা। এ জন্য নির্বাচনের আগে যে কোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই সঙ্গে অর্থনীতিক কর্মকাণ্ডে যেন কোনো রকম ছেদ না ঘটে সেদিকেও তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সম্প্রতি এ নির্দেশনা অর্থ বিভাগের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে রাজস্ব আদায়ে টান পড়ায় সরকারের সামগ্রিক আয় কমে গেছে। অথচ বেড়েছে ব্যয়ের চাহিদা। যদিও সংকুচিত বাজেটে উন্নয়ন ব্যয়ে ব্যাপক কাটছাঁট করা হচ্ছে। কিন্তু অনুন্নয়ন ব্যয়ের লাগাম কিছুতেই টানতে পারছে না। ডলারের বাজারে সরবরাহ বাড়ায় অস্থিরতা কমেছে। রিজার্ভ আবার ৩২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু ডলারের বাজারের সংকট এখনো কাটেনি। কেননা মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে এখনো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি রয়েছে। নির্বাচনকালীন এটা আরও সংকুচিত হবে। তবে নির্বাচনের কারণে গ্রামাঞ্চলে বাড়বে টাকার সরবরাহ। কোথাও কোথাও কালো টাকার দৌরাত্ম্যও বাড়তে পারে। যা মূল ধারার অর্থনীতির গতিকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় দেশে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই বাড়বে। এখানে সব সময় কালো টাকার একটা আশঙ্কা তো থাকেই। এবার হয়তো সে রকম কিছুটা কম হতে পারে। কিন্তু সেটা তো বন্ধ হয়ে যায়নি। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরই সবকিছু নির্ভর করে। পরিস্থিতির অবনতি হলে স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতিতে ঝুঁকি বেড়ে যায়। এদিকে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থনীতি সম্পর্কিত সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। যারা বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত তাদেরও বাজেট বাস্তবায়নের গতি ধরে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে উৎপাদন, সরবরাহ চেইনে যেন কোনো রকম ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। বাজেটে চাহিদার জোগান স্বাভাবিক রাখতে রাজস্ব খাতের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এদিকে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেছেন, চাকরির বাজারে বৈষম্যের বিরুদ্ধেই দেশে এ বিপ্লব হয়েছে। যে তিনটা সংখ্যার ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে সেই তিনটি যে কোনো সময় ভেঙে পড়লে আমরা কী করব আমি জানি না। বিশ্বব্যাংক বলছে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে এবং দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলো কোনো ভালো লক্ষণ নয়। অন্য সূচকগুলো দেখেও আমরা ভালো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। যা দেখা যাচ্ছে সেটা খুবই উদ্বেগজনক। নির্বাচনকালীন পরিস্থিতির ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন এপ্রিল পর্যন্ত হয়েছে মাত্র ৩৪.৭২ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে হার ছিল ৩৫.৮৬ শতাংশ। খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিক্ষা (১৮.৯৬ শতাংশ), স্থানীয় সরকার (১৮.৫২ শতাংশ), জ্বালানি (১৭.৪০ শতাংশ) ও পরিবহন-যোগাযোগ (১৭.৩৫ শতাংশ) খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ থাকলেও ব্যয় কাক্সিক্ষত মাত্রায় হয়নি। নির্বাচন কেন্দ্র করে এ গতি আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে।
সরকার ঋণ শোধের চাপ সামলাতে গিয়ে উন্নয়ন ব্যয় বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ছে। রাজস্ব ব্যয় ক্রমেই অপ্রযোজ্য খাতে বাড়ছে, অথচ সামাজিক খাত, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগের ঘাটতি বাড়ছে। যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে অর্থনীতির ওপর দ্বিমুখী চাপ সৃষ্টি হবে- এক দিকে ঋণের বোঝা বাড়বে, অন্য দিকে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কার্যালয়ের নির্দেশনার আলোকে এরই মধ্যে পরিপত্রও জারি করেছে অর্থ বিভাগ। নির্বাচনি ডামাডোলের প্রভাবে যেন বাজেট বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকেও নজর রাখতে বলা হয়েছে মন্ত্রণালয়গুলোকে।