ঐতিহাসিক চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানের পর জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতি নিরাপত্তার সংকটে পড়েছে? নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই রাজধানীতে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় সামগ্রিক নিরাপত্তাকে অবিশ্বাস্য রকমের নাড়া দিয়েছে। এ ঘটনায় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সমর্থক থেকে সর্বস্তরের মানুষ রীতিমতো হতভম্ব। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে প্রকাশ্যে গুলি করা হলো। এর আগে গত ৭ নভেম্বর বিএনপিঘোষিত চট্টগ্রাম-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী এরশাদউল্লাহকে প্রকাশ্যে গুলি করা হয়। তাহলে রাজনীতিতে নিরাপত্তাটা কোথায়? এই পরিস্থিতিতে প্রার্থীরা কীভাবে নির্বাচন করবেন, কী করে নির্বাচনে অংশ নেবেন? আর দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থাই বা কোন দিকে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন এখন বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষের। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কী হতে যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে?
এ প্রসঙ্গে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সব রাজনৈতিক নেতারা যাতে নিরাপদে থাকে, সে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। ওসমান হাদির ওপর হামলাকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে না। কারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে ১১ ডিসেম্বর, তার পর দিনই বাংলাদেশে একজন সম্ভাব্য জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীর ওপরে হামলা হলো। হামলার ধরন দেখেই বোঝা যায় এটা পেশাদার শুটারের কাজ।’ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘কোনো আশঙ্কাকেই আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। এখানে সরকারের দায়িত্ব আছে, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব আছে। জনগণের সচেতনতা জরুরি।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যৌথ বাহিনী, সরকার, জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ এই ধরনের ঘটনা আমরা বন্ধ করতে পারব। আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য অটুট রাখব। ঐক্যকে সুদৃঢ় করব। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক হতে পারে, সামনে নির্বাচন বিভিন্ন রকমের রাজনৈতিক বিতর্ক হবে কিন্তু আমরা ওই পর্যায়ের বিতর্ক করব না, যাতে আমাদের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়।’ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই একজন অন্যতম জুলাই যোদ্ধা এবং এমপি প্রার্থীর ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালানোর ঘটনা নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ ধরনের বর্বর হামলা দেশের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করে। তিনি বলেন, ওসমান হাদি গত ১৩ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক স্ট্যাটাসে জানান ৩০টি বিদেশি নম্বর থেকে কল ও টেক্সট করে তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশবাসীর কাছে এটা পরিষ্কার যে প্রশাসন তাঁর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। হামলাকারীদের অবিলম্বে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে হবে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রার্থী, দলীয় কর্মী ও সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তায় কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
শরিফ ওসমান হাদির ওপর সশস্ত্র হামলার ঘটনাকে গণতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত এবং নির্বাচন বানচালের সুস্পষ্ট অপচেষ্টা বলে অখ্যায়িত করেছেন করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম এবং আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তাঁরা বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই ‘ফ্যাসিবাদের দোসররা’ সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচনি পরিবেশ নষ্ট করার চেষ্টা শুরু করেছে। রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনে গুলি ও হামলার মতো আচরণ কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। আসন্ন নির্বাচনে সব প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে নেতারা বলেন, নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে যে কোনো সহিংসতা ‘চরম অগ্রহণযোগ্য’। জনগণের নিরাপত্তা এবং প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিতে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
জানা গেছে, ‘জুলাই গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক এই ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা’কে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে শুরু করে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, নিরাপত্তা বাহিনী ও বিশ্লেষকরা কেউ-ই বিচ্ছিন্ন কিংবা স্বাভাবিক কোনো ঘটনা হিসেবে দেখছেন না। তাঁরা সবাই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘটনাটিকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন এবং ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তাঁর উপস্থিতিতে শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি। আগামী দুই-এক দিনের মধ্যেই এই সভার আয়োজন করা হবে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণকারীদের ধরিয়ে দিতে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল বিএনপি সারা দেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনতে নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি দল এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। তারপরও আতঙ্ক কাটছে না রাজনীতিতে। এই নিরাপত্তাসংকট কাটাতে তাঁরা সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। নিজেরাও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। পতিত আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধিতায় সরব ওসমান হাদির ওপর হামলার নিন্দা জানাচ্ছেন গণ অভ্যুত্থানে সক্রিয় তরুণ নেতারা। তাঁরা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ জুলাই আন্দোলনের নেতাদের হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে। এই মিশন যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, শরিফ ওসমান হাদির ওপর আঘাত মানে জুলাইয়ের ওপর আঘাত।। তিনি বলেন, ওসমান হাদি জুলাইয়ের একটা চরিত্র। ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনায় ২৪ ঘণ্টা পার হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, হাদির ওপর আঘাত মানে জুলাইয়ের ওপরে আঘাত।
ওসমান হাদির মর্মান্তিক ও নৃশংস ঘটনায় রাজনীতিবিদদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) সভাপতি ও জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এই পরিস্থিতিতে প্রার্থীরা কীভাবে নির্বাচন করবেন, কী করে নির্বাচনে অংশ নেবেন? সামগ্রিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে তিনি বলেন, মব, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস চলছে। জুলাই আন্দোলনের পরও আগের মতো নির্বাচন হলে অভ্যুত্থানের মর্মটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
জাতীয় পার্টির একাংশের মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় সারা দেশে একটা সংশয় বিরাজ করছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশব্যাপী ১ হাজার ৯৩১ জন খুন হয়েছেন। দেশের সাধারণ মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আজ সন্ত্রাসের বলি হচ্ছে।