Image description

রাজধানী জুড়ে একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক বাড়ছে। কোথাও শীর্ষ সন্ত্রাসীকে প্রকাশে রাস্তায় ফেলে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। কোথাও আবার দোকানের ভেতর ঢুকে রাজনৈতিক নেতার বুকে গুলি চালানো হচ্ছে। আর সবশেষ দিনেদুপুরে মাথায় গুলি করে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র এমপি প্রার্থী শরীফ ওসমান বিন হাদিকে। এ ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এমন ব্যক্তিকে টার্গেট করে একের পর এক গুলির ঘটনা ঘটেই চলেছে। যা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। 

হাদিকে গুলি চালানোর প্রত্যক্ষদর্শী বক্স কালভার্ট রোডের ডিআর টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী লুৎফর রহমান বলেন, জুমার নামাজের পর দুপুরের দিকে বিজয় নগরের বক্স কালভার্ট এলাকা দিয়ে রিকশায় করে যাচ্ছিলেন ওসমান হাদি। এ সময় পেছন দিক থেকে মোটরসাইকেলে করে এসে দুই যুবক হাদিকে গুলি করে। গুলি করে তারা দ্রুত চলে যায়। তিনি বলেন, দিনেদুপুরে সকলের সামনে রাস্তায় এমন গুলি চালানো হয়েছে সেটা আমরা প্রথমে বুঝতেই পারিনি। মনে করেছি কোনো টায়ার  ব্লাস্ট হয়েছে। পরে দেখি হাদির সঙ্গে থাকা লোকটি চিৎকার করছেন। তখন আমরা বেশ ভয় পেয়ে যাই।

হাদিকে গুলি করার একদিন আগে গত ১১ই ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে আবদুর রহমান ভূঁইয়া (৫৫) নামের এক মসলা ব্যবসায়ীর দোকানে ঢুকে প্রকাশ্যে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। আশপাশের দোকানিরা তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত আবদুর রহমানের ছোট ভাই শফিকুল ইসলাম বলেন, পাশের এক দোকানির সঙ্গে তার ভাইয়ের দোকান বসানো নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে সালিশ বৈঠক হয়। আদালতে মামলাও হয়েছে। এর জের ধরেই আমার ভাইকে টার্গেট করে ওই ব্যবসায়ী। একপর্যায়ে ওইদিন সকলের সামনে দোকানে ঢুকে গুলি করে আমার ভাইকে হত্যা করে সে। সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মতিউর রহমান ওই ব্যবসায়ীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, শ্যামবাজার মাওলা বক্স চক্ষু হাসপাতালের সামনে আব্দুর রহমানকে গুলি করা হয়। স্থানীয়দের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, নয়ন নামে এক যুবক তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্যামবাজারের বেশ কয়েকজন ব্যাবসায়ী বলেন, দোকান নিয়ে হোক আর যা নিয়েই দ্বন্দ্ব হোক তাই বলে এইভাবে দোকানে ঢুকে গুলি করে হত্যা করার কথা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। তারা বলেন, আগে মানুষের রাগ হলে দুই-একটা চড়-থাপ্পড় দিতো, কিন্তু এখন কিছু হলেই গুলি করে দেয়। আবার টাকা খরচ করে সিনেমার মতো মানুষকে দিয়েও হত্যা করানো হচ্ছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নাকি এত তৎপর তাহলে এত অস্ত্র কোথা থেকে আসছে!

এর আগে গত ১৭ই নভেম্বর সন্ধ্যায় মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকের বিক্রমপুর হার্ডওয়্যার অ্যান্ড স্যানিটারি নামে একটি দোকানের ভেতর ঢুকে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করা হয়। মাথায় হেলমেট পরে মোটরসাইকেলে এসে সেদিনও সকলের সামনে ব্লাক রেঞ্জ থেকে গুলি চালিয়ে কিবরিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় তারা। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওইদিন গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে একজন রিকশাচালকও গুলিবিদ্ধ হন। ওই ঘটনার পর বেশ কয়েকজন আটক হয়েছে।  

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মাহবুব আলম বলেন, মূলত রাজনৈতিক মেরূকরণের পরে স্থানীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে কিবরিয়ার হাতে চলে আসতে থাকে। এই কারণেই যাদের সঙ্গে আগে তার সখ্যতা ছিল, একসঙ্গে জেল খেটেছেন, রাজনীতি করেছেন তাদের শত্রু বনে যান তিনি। বিদেশে বসেই কিবরিয়াকে টার্গেট করে হত্যার ছক কষা হয়। 

কিবরিয়াকে হত্যার ঠিক পাঁচ দিন আগে গত ১১ই নভেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২-এ হাজিরা দিতে গিয়ে নিহত হন শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুন (৫৫)। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটের সামনে ফেলে একের পর এক গুলি করে হত্যা করা হয়। মুখে মাস্ক পরে রাস্তার তীব্র যানজটের মধ্যে ধাওয়া করে মামুনকে গুলি করে হত্যা করে দুই সন্ত্রাসী। এরপর সকলের সামনে দিয়েই কোমড়ে পিস্তল গুজে ভিক্টোরিয়া পার্কের দিকে চলে যায় তারা। রাকিব নামে মামুন হতাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আমি হাসপাতালের গেটের সামনে ছিলাম। রাস্তার পাশে। এরই মধ্যে একটা গাড়ি থেকে দেখি ওই লোকটা নামলেন। তার সঙ্গে আরও একজন ছিল। তার হাতে দামি মোবাইল ছিল। গাড়ি থেকে নামতেই তাকে লক্ষ্য করে দু’জন গুলি শুরু করে তখন রাস্তায় পুলিশ ছিল, হাসপাতালের গেটে নিরাপত্তাকর্মীরা ছিল। সবার মাঝেই ওই দু’জন গুলি করে মোটরসাইকেলে করে চলে যায়। কেউ তাদেরকে আটকানোর সাহস করেনি। আর এই পুরো ঘটনাটি ঘটে ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে। 

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের গত ১১ মাসে সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে মোট মামলা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫০৫টি। শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতেই মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৫০২টি। এসবের মধ্যে শুধু খুনের ঘটনাতেই মামলা দায়ের হয়েছে ৩ হাজার ৫০৯টি। 

বিষয়টি নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, মূলত এটি নিয়ে যাদের মাথাব্যথা করার কথা তারা এটি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। বরং এসব সন্ত্রাসীদের তারা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছেন। তারাই এদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে নির্মূল করা সম্ভব না। কারণ এই সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক কোনো কমিটমেন্ট নাই। এসব সন্ত্রাসীদের নিভৃত করা, দমন করার সিদ্ধান্ত সেখান থেকেই আসতে হবে। তা না হলে একেক সময় একেক সন্ত্রাসী আসবে। 

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময় অপরাধপ্রবণতা অনেক কমে আসার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে একটি চক্র তৈরি হয়েছে যারা অপরাধটি তার আয়-উপাজর্নের উৎস মনে করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিৎ আরও বেশি সতর্ক থাকা। তাদের টহল কার্যক্রম বাড়ানো ও অভিযুক্তদের দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা।