Image description

ব্যবসায়ীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনঃতফসিল সুবিধা অনুমোদন করা হলেও খেলাপি ঋণ কমছে না, বরং বাড়ছে। এর মূল কারণ বলা হচ্ছে, ব্যাংকগুলো এই সুবিধা বাস্তবায়নে অনাগ্রহী। ‎খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সুবিধায় দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ড ও মাত্র ১-২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দেওয়ার বিধান রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠনের জন্য নিরাপদ নয়। এতে আমানত ঝুঁকিতে পড়ে এবং ঋণ আদায় কঠিন হয়। অনেক প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতা অনুমোদন পাওয়ার পর ব্যাংকের সঙ্গে আর কোনো আলোচনায় বসছেন না।

‎অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনুমোদন পাওয়ার পরও ব্যাংক সহযোগিতা করছে না এবং আগের পুনঃতফসিলকারীদের ওপর বাড়তি বোঝা পড়ছে। ফলে স্কিমটি উল্টো ব্যর্থ হয়ে নতুন খেলাপি বাড়ছে। 

Kiswan

‎বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪৪ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। সরকার পরিবর্তনের আগে গত জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১১ লাখ কোটি টাকা। যা ছিল মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। আর গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৪৫ লাখ কোটি টাকা, যা ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করতে চাইছে। কিন্তু এই নীতির ত্রুটি দূর না হলে পুনঃতফসিল কার্যকর হবে না, আর খেলাপিও কমবে না।

 

‎জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে নানারকম ছাড় দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ২০২২ সালের জুলাইয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পুরো ক্ষমতাই ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর ব্যাংকগুলোর হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর থেকে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বেড়েছে। কারণ ব্যাংকের পর্ষদই এখন খেলাপি ঋণ নবায়নের সিদ্ধান্ত দিতে পারছে। আবার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা আসার কারণেও ঋণ নিয়মিত রাখতে পুনঃতফসিল সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া বিগত সরকারের সময় এ-সংক্রান্ত নীতিমালাও শিথিল করা হয়। যেমনÑ বর্তমানে ঋণ পুনঃতফসিলে মাত্র আড়াই থেকে সাড়ে চার শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হয়, আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধে গ্রাহকদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে পাঁচ থেকে আট বছর, যা আগে সর্বোচ্চ তিন বছর ছিল। বিশেষ বিবেচনায় কোনো খেলাপি ঋণ চারবার পর্যন্ত পুনঃতফসিলের সুযোগ রাখা হয়েছে, আগে তিনবারের বেশি পুনঃতফসিল করা যেত না। এ রকম অবস্থায় গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি কমিটি গঠন করে বিশেষ বিবেচনায় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে আসায় ব্যবসায়িক কার্যক্রমে গতি আনতে বড় করপোরেট ঋণখেলাপিসহ প্রায় ২৫০টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

‎আবার ঢালাওভাবে সব ঋণখেলাপিকে এই বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলো এবং তা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ বিবেচনায় আরও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন করতে পারবে ব্যাংকগুলো।

‎মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিপরীতে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা যাবে। দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ড এবং সংশ্লিষ্ট খাতের সর্বনিম্ন সুদহারের চেয়েও এক শতাংশ কম সুদ নির্ধারণ করা যাবে। ব্যাংকগুলোই এসব সুবিধা দিতে পারবে।

‎গত ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকগুলোকে আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ এরকম মন্দ ও ক্ষতিজনক শ্রেণির ঋণ আংশিক অবলোপন করার অনুমোদন দেয়। মূলত ব্যাংকের ব্যালান্স শিট থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

‎কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঋণগ্রহীতা ও ব্যবসায়ীদের আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে নীতি সহায়তা সার্কুলারগুলো আরও গুরুত্বসহ পরিপালনের জন্য ব্যাংকগুলোর এমডিদের নির্দেশনা দেন গভর্নর।

‎তিনি বলেন, ‘মন্দ ও ক্ষতিজনক শ্রেণির এবং আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ, এমন ঋণ আংশিক অবলোপন করার জন্য গভর্নর বিশেষ পরামর্শ দিয়েছেন।’

‎‎বাংলাদেশ ব্যাংকে বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের এমডিদের সঙ্গে এক সভায় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবস্থান ১৪-১৫ শতাংশ, যদিও মোট ঋণের মাত্র ২ শতাংশ পাচ্ছে এ খাত। তিনি কৃষিঋণ বাড়িয়ে ১০ শতাংশের বেশি করার পরামর্শ দেন। এসএমই গ্রাহকদের ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর এবং সিএমএসএমই ঋণের প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ করতে ব্যাংকগুলোর এমডিদের পরামর্শ দেন গভর্নর। তিনি এমডিদের আশ্বস্ত করেন, সিএমএসএমই ঋণের ক্ষেত্রে প্রভিশনিং ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০ দশমিক ৫ শতাংশ করা হবে।

‎বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত সরকারের সময় লুকানো খেলাপি ঋণ বেরিয়ে আসায় ব্যাংক খাতে সার্বিকভাবে এর পরিমাণ তাদের হিসাবে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

‎‎‎বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ছত্রছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে। এখন সেই টাকা ব্যাংকের জন্য আদায় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’