বাংলাদেশের ১ শতাংশ মানুষের কাছে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের ২৪ শতাংশ। আর মোট জাতীয় আয়ের ১৬ শতাংশ রয়েছে তাদের হাতে। কোন দেশে বৈষম্যের মাত্রা কেমন, তার ওপর বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট-২০২৬’ বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন তথ্য দিয়েছে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে মানুষের আয়ের চেয়ে সম্পদের বৈষম্য অনেক বেশি।
প্যারিসভিত্তিক বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব সম্প্রতি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বিভিন্ন দেশের জাতীয় উপাত্ত পর্যালোচনা এবং বিস্তৃত গবেষণার মাধ্যমে বৈষম্য পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়, বিশ্বে বৈষম্য অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের। মাত্র ১০ শতাংশ ধনী মানুষের কাছে মোট সম্পদের ৭৫ ভাগ রয়েছে। বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা এর সবচেয়ে বড় কারণ। এ ব্যবস্থায় ধনীদের সম্পদ ক্রমাগত বাড়ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈষম্যের বৈশ্বিক বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান মাঝামাঝি। আয় ও সম্পদ উভয় বিবেচনায় দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বের শীর্ষ বৈষম্যের দেশ। আয় বৈষম্যে দ্বিতীয় অবস্থানে কলম্বিয়া। সম্পদ বৈষম্যে দ্বিতীয় রাশিয়া। আয় বৈষম্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। ভারত ও পাকিস্তানে বৈষম্য বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে বিশ্বের ৪০টি দেশের বৈষম্যের চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বৈশ্বিক বৈষম্য পরিস্থিতি পর্যালোচনার পাশাপাশি ৪০টি দেশের ওপর আলাদা পর্যালোচনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বৈষম্য মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে এবং গত এক দশকে খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যায়নি। আয়ের বিবেচনায় দেশের শীর্ষ ১০ শতাংশ আয়ের মানুষ মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ৪১ শতাংশ উপার্জন করে। যেখানে নিচের ৫০ শতাংশের আয় মাত্র ১৯ শতাংশ। সম্পদের বণ্টনে বৈষম্য আরও বেশি। শীর্ষ ১০ শতাংশের হাতে মোট সম্পদের প্রায় ৫৮ শতাংশ। আর শীর্ষ ১ শতাংশের হাতে রয়েছে ২৪ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ধনী ১ শতাংশ মানুষের গড় সম্পদ ৭ লাখ ২৩ হাজার ২৩৮ ইউরো। প্রতি ইউরো ১৪২ টাকা ধরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে, নিচের দিকের ৫০ শতাংশের গড় সম্পদ এক হাজার ৪২২ ইউরো বা প্রায় দুই লাখ টাকা। তাদের হাতে রয়েছে সম্পদের মাত্র ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। তাদের ওপরের ৪০ শতাংশের কাছে রয়েছে সম্পদের ৩৭ শতাংশ। আর শীর্ষ ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে ৫৯ শতাংশ।
বাংলাদেশে ওপরের দিকে আয়ের ১০ শতাংশ মানুষের কাছে রয়েছে জাতীয় আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে, নিচের দিকের আয়ের ৫০ শতাংশের কাছে রয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশ। মাঝখানের স্তরে বাকি ৪০ শতাংশের কাছে রয়েছে ৪০ শতাংশ আয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় বছরে দুই হাজার ৮২০ ডলার। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্টে ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ১৫২ ইউরো। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী সাত হাজার ১৪৫ ডলার। একই পরিমাণ টাকা দিয়ে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন পরিমাণ পণ্য ও সেবা পাওয়া যায়। এ কারণে জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে পিপিপি ব্যবহার করা হয় যাতে বিভিন্ন দেশের মানুষের প্রকৃত আয়ের ক্ষমতা, জীবনমান এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ন্যায্য ও সঠিক তুলনা করা যায়।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের তথ্যের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ সমকালকে বলেন, আয় বৈষম্য বাড়লে, সম্পদের বৈষম্য বাড়ে। তিনি বলেন, ‘এটি নিশ্চিত যে, বাংলাদেশে বৈষম্য ভয়াবহ আকারে বেড়েছে। আমরা হা-হুতাশ করছি, কিন্তু বৈষম্য কমাতে পারছি না। বৈষম্য বৃদ্ধির পেছনে নানা কারণ রয়েছে। আমাদের বেশির ভাগ মানুষ নিজেকে বিকাশের সুযোগ পায় না। বৈষম্য কমাতে শিক্ষার মান ভালো করতে হবে। ভালো স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপে দেশে বৈষম্য পরিস্থিতির চিত্র পাওয়া যায়। বৈষম্য সূচকের পরিমাপক জিনি অনুপাতে বাংলাদেশের স্কোর শূন্য দশমিক ৪৯। এই অনুপাত শূন্য থেকে ১ পর্যন্ত। শূন্য মানে বৈষম্য নেই এবং ১ মানে পূর্ণ মাত্রার বৈষম্য। বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের হাতে রয়েছে জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে, সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশের হাতে রয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ আয়ের ৫ শতাংশের আয়ের পাশাপাশি বিবিএস ১০টি স্তরে আয়ের অংশ প্রকাশ করে। ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, দশম স্তরের কাছে রয়েছে জাতীয় আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে, প্রথম স্তরে রয়েছে আয়ের ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ এখনও খুব কম। মাত্র ২২ দশমিক ৩ শতাংশ, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থায়ী লিঙ্গবৈষম্যের প্রতিফলন। সার্বিকভাবে বাংলাদেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনে বৈষম্যের ধরন প্রায় অপরিবর্তিত রয়ে গেছে এবং আরও সুষম বণ্টনের দিকে অগ্রগতি সীমিত।