Image description

পণ্যভর্তি কনটেইনার পরিবহন করা হয় কনটেইনারবাহী জাহাজে। ২০২০ সাল থেকে কনটেইনারবাহী জাহাজে সাবের হোসেন চৌধুরীর কর্ণফুলী গ্রুপ বিনিয়োগ করে আসছে। সে বছরের জুনে কর্ণফুলী গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এইচআর লাইনস কনটেইনার জাহাজ পরিচালনার ব্যবসা শুরু করে। জাতীয় পতাকাবাহী এইচআর লাইনস এখন আটটি ফিডার জাহাজ পরিচালনা করছে, যার মাধ্যমে প্রায় ১১ হাজার টিইইউ কনটেইনার পরিবহন করা যায়।

শিপিংবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ ও পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান আলফালাইনারের ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১০০ কনটেইনার জাহাজ কোম্পানির মধ্যে সাবের হোসেন চৌধুরীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান এইচআর লাইনসের অবস্থান ছিল ৭১তম। এর দুই ধাপ ওপরে অবস্থান করছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত শিপিং করপোরেশন অব ইন্ডিয়া। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো কোম্পানি এ তালিকায় নেই।

সমুদ্রপথে কনটেইনার পরিবহন ও জাহাজে গত এক দশকে সাবের হোসেন চৌধুরী ও তার পরিবারের একক আধিপত্য দেখা গেছে, যা এখনো অটুট রয়েছে। গত বছর গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলেও দলটির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর পরিবারের এ ব্যবসায় ভাটা পড়েনি।

 

কর্ণফুলী গ্রুপ এইচআর লাইনসের মূল প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৪ সালে বাংলাদেশে শিপিং ব্যবসার প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তা হেদায়েত হোসেন চৌধুরীর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কর্ণফুলী গ্রুপ। তার ছেলে সাবের হোসেন চৌধুরীর মাধ্যমে গ্রুপটি দ্বিতীয় প্রজন্মে আসে এবং এখন এটি তার সন্তানদের মাধ্যমে তৃতীয় প্রজন্মে পরিচালিত হচ্ছে।

 

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে কনটেইনার খাতে ব্যবসা করছে মূলত আন্তর্জাতিক বড় বড় কোম্পানি। বাংলাদেশে সরাসরি ও এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশী কোম্পানিগুলো এ ব্যবসা পরিচালনা করছে। তবে বাংলাদেশের স্থানীয় কোম্পানি হিসেবে কর্ণফুলী গ্রুপ একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।’

মূলত ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় বছর পর এইচআর লাইনস যাত্রা করে এবং অতি অল্প সময়ে শীর্ষ ১০০ কনটেইনার জাহাজ কোম্পানির তালিকায় উঠে আসে।

বাংলাদেশের শিপিং ও লজিস্টিকস খাত দীর্ঘদিন ধরে কর্ণফুলী গ্রুপের ওপর নির্ভরশীল। গ্রুপটি শুরু থেকে ধীরে ধীরে কাগজ-যানবাহন আমদানি, ভারী শিল্প যন্ত্রপাতি পরিবহন—এসব খাতের পাশাপাশি লজিস্টিকস, শিপিং ও ইন্টারনাল ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। কর্ণফুলী গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলো কার্গো পরিবহন, ডিপিং, জাহাজ মেরামত, পণ্য হ্যান্ডলিং ও বন্দরনির্ভর সাপ্লাই চেইন অপারেশন পরিচালনা করে। বিশেষ করে কর্ণফুলীর নিজস্ব পরিবহন ও শিপিং অবকাঠামো তাদের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দিয়েছে।

দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কর্ণফুলীর নিজস্ব জাহাজ, বার্জ, পরিবহন-বহর ও বন্দরভিত্তিক অপারেশন রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর ও লজিস্টিকস খাতে দীর্ঘদিনের উপস্থিতি এবং নেটওয়ার্ক তাদের শিপিংসংক্রান্ত সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব এনে দিয়েছে। কর্ণফুলী গ্রুপের এ সক্ষমতা শুধু তাদের নিজস্ব ব্যবসা নয়, বরং দেশের বড় আমদানিকারক, ডিস্ট্রিবিউটর ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পণ্য পরিবহনকেও দীর্ঘদিন ধরে সুবিধা দিয়ে আসছে।

কর্ণফুলী গ্রুপ বাংলাদেশে একটি বহুমুখী কনগ্লোমারেট। গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, এর বার্ষিক টার্নওভার ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি। কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ হাজারের বেশি মানুষের। কর্ণফুলী বাংলাদেশের শিপিং লজিস্টিকসে যে প্রভাবশালী অবস্থান ধরে রেখেছে, তাতে তাদের বার্ষিক টার্নওভার দেশের শীর্ষ কনগ্লোমারেটের সঙ্গে তুলনীয় বলে শিল্প মহলে ধারণা রয়েছে।

গত বছরের শেষদিকে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে আসা ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামের একটি জাহাজকে ঘিরে সাবের হোসেন চৌধুরীর নাম আলোচনায় আসে। জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট চৌধুরী পরিবারের মালিকানাধীন শিপিং কোম্পানি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।

শিপিং লাইনে যুক্ত একাধিক ব্যবসায়ীর ভাষ্যমতে, সাবের হোসেন চৌধুরী এখন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে বড় ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন। প্রথম ধাপে পানগাঁওয়ের সন্নিকটে তারা একটি ওয়্যারহাউজ স্থাপন করতে চান। কারণ আমদানি-রফতানির পণ্য তুলা-কটনসহ বেশির ভাগ বড় কারখানা ঢাকা অঞ্চলে অবস্থিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী মাতারবাড়ী বন্দর থেকে এসব কাঁচামাল নদীপথে ফিডার জাহাজে করে আনা হবে পানগাঁও নৌ-টার্মিনালে। এ ব্যবস্থা কার্যকর হলে বাংলাদেশে শিপিং খাতে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মেডিটেরিনিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে। এর সমান্তরালে সাবের হোসেন চৌধুরীর ব্যবসায়িক কার্যক্রমও বিস্তৃত হবে। উল্লেখ্য, এমএসসির বাংলাদেশে সরাসরি এজেন্টও তিনি।

ঢাকার কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা তীরের পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব ২২ বছরের জন্য দেয়া হয়েছে এমএসসি গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেডলগের কাছে। এ নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও মেডলগ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে কনসেশন চুক্তি সই হয়েছে। এ মেডলগের ব্যবসা পরিচালনায় বাংলাদেশে যুক্ত রয়েছে সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান।

প্রথম সারির একজন বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুরু থেকে বন্দরসংক্রান্ত বড় বড় সিদ্ধান্ত ও চুক্তির পেছনের কলকাঠি নেড়েছেন সাবের হোসেন চৌধুরী। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে রেড সি গেটওয়ে গ্রুপের আসার ক্ষেত্রে তার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল। এছাড়া সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মেডিটেরিনিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) বাংলাদেশে সরাসরি এজেন্টও তিনি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর সাবের হোসেন চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হলে এমএসসি ও তাদের দেশের দূতাবাস সাবের হোসেনের মুক্তির ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তদবির করে। ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গেও ২০০৭ সাল থেকে তার সরাসরি যোগাযোগ ও কাজের সম্পর্ক রয়েছে।’ এখনো কর্ণফুলী গ্রুপের ওয়েবসাইটে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় ডিপি ওয়ার্ল্ডের নাম রয়েছে। উল্লেখ্য, সাবের হোসেন চৌধুরী গত বছরের ৮ অক্টোবর জামিনে মুক্তি পান।

শিপিং ব্যবসায় যুক্ত প্রথম সারির একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাবের হোসেন চৌধুরীর মূল প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্রুপ। আর এমএসসির বাংলাদেশে কনটেইনার ব্যবসার অংশীদার তিনি। এইচআর লাইনসও তার পারিবারিক ব্যবসা। দেশে কনটেইনার শিপিং ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে এ পারিবারের হাতে। যেমন কে-লাইন, ওয়ান লাইনের মতো কনটেইনার শিপিং ব্যবসা তার আত্মীয়স্বজনদের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে পিআইএল শিপিংয়ের অধীনে কনটেইনার ও ফিডার জাহাজ পরিচালনাও তার নিয়ন্ত্রণে। সি কনসোর্টিয়াম কোম্পানির মাধ্যমেও তার ফিডার জাহাজ ব্যবসা রয়েছে।’

বন্দর ও মন্ত্রণালয়ের ভেতরকার সূত্রের দেয়া তথ্য বলছে, ক্ষমতার পালাবদলেও প্রভাবশালী হিসেবে উচ্চারিত হয় সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর নাম। বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশী অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে তার পারিবারিক বলয়ের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। দেশে বিভিন্ন বিদেশী অপারেটরের স্থানীয় প্রতিনিধির তালিকা ঘাঁটলে সেখানে সাবের হোসেনের পরিবারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম পাওয়া যায়।

বিদেশী অপারেটর ইস্যুতে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ঘিরে। বন্দরের সবচেয়ে আধুনিক ও লাভজনক এ টার্মিনাল পরিচালনায় প্রতি বছর সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে চুক্তি নবায়ন হয়ে আসছে। কখনো আন্তর্জাতিক টেন্ডার হয়নি। এনসিটিকে দীর্ঘমেয়াদে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেয়ার জোরালো তৎপরতা চলছে। বিদেশী এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও শুরু থেকে দীর্ঘ সময় ধরে যুক্ত সাবের হোসেন চৌধুরী।

জানা গেছে, বাংলাদেশে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে পরিচয় করিয়ে দেয়া ব্যক্তিটি তিনিই। তার সঙ্গে ডিপি ওয়ার্ডের পরিচয়ের মূলে ছিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কনটেইনার শিপিং হ্যান্ডলিং প্রতিষ্ঠান এইচআর লাইনস।

বিদেশী অপারেটর নিয়োগের পেছনে সাবের হোসেন চৌধুরীর কোনো ভূমিকা থাকার বিষয়ে বন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বন্দর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। কোনো বিদেশী অপারেটরের স্থানীয় প্রতিনিধি বা তাদের নেটওয়ার্কের প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ নেই।

রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাবের হোসেন চৌধুরীর শিপিং লাইন ব্যবসা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যথাযথ প্রতিযোগিতা করে ভালোভাবেই টিকে ছিল এবং ভালো ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। অতীত বা বর্তমানে যেভাবেই দেখি সাবের হোসেন চৌধুরীদের শিপিং লাইনের ব্যবসা ভালোভাবেই চলছে। এসব ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ ব্যক্তি যদি কোনো সরকারের সঙ্গে থেকে আনডিউ অ্যাডভানটেজ নেয় বা রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তাহলে ব্যক্তির শাস্তি হতে পারে। কিন্তু ওই ব্যক্তির শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য যেমন জনাব সাবের হোসেন চৌধুরীর শিপিং লাইন, এটা বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ, এগুলোতে কোনো হস্তক্ষেপ করা বা ব্যবসার কোনো ক্ষতি করলে সেটা আসলে দেশের ক্ষতি।’

সামগ্রিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাবের হোসেন চৌধুরী ও কর্ণফুলী গ্রুপের গ্রুপ ডিরেক্টর হামদান হোসেন চৌধুরীর মুঠোফোনে কল দেয়া হলেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।