জাতির বহু কাক্সিক্ষত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হচ্ছে আজ। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার যাবতীয় প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে। ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গতকাল সাংবাদিকদের জানান, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) ঘোষণা করা হবে। সন্ধ্যা ৬টার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন এবং তফসিল ঘোষণা করবেন।
এর আগে আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে গতকাল বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সিইসি ও চার কমিশনার। এরপরই বিকেলে জাতির উদ্দেশে সিইসির ভাষণ বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারে রেকর্ড করা হয়। ওই ভাষণ রেকডের্র মধ্য দিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা চূড়ান্ত হয়েছে। ইসির নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, ১২ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এবারের নির্বাচনটি দেশবাসীর যেমন বহু প্রত্যাশিত তেমনি কাক্সিক্ষত গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি এই নির্বাচনের দিনই অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। আর এই গণভোটের রায়ে নির্ধারিত হবে সংবিধানসহ রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের ভবিষ্যত। বিগত ২০০৮ সালের পর থেকে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনই হয়েছে একতরফা। ২০১৪ সালের বিনাভোটের নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে ১৫২টি আসনের প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। এরপর ২০১৮ সালে আগের দিন রাতেই ভোট কেটে ব্যালট বাক্সে ভর্তি করে রাখা হয়। এ জন্য এই নির্বাচনকে দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলে আখ্যায়িত করা হয়। অন্য দিকে, সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনকে বলা হয় আমি-ডামির নির্বাচন। এসব নির্বাচনে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারেনি, তারা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের তিন কোটির বেশি ভোটার এখন পর্যন্ত তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। অনিয়ম-কারচুপির এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার কায়েম। হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটে। গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। ওই প্রার্থীরা ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। চলছে তাদের প্রচার-প্রচারণা। বলা যায়, সারা দেশে নির্বাচনী হাওয়া আরো আগে থেকেই বইছে। পুরো দেশ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। শুধু তাই নয়, আসন্ন নির্বাচনের দিকে আন্তর্জাতিক মহলেরও তীক্ষè দৃষ্টি রয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আসন্ন নির্বাচনকে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ প্রসঙ্গে গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা থেকে সারা দেশের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, এই নির্বাচনকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের মাধ্যমে স্মরণীয় করে রাখতে হবে। সব জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা এ সময় অনলাইনে যুক্ত ছিলেন। আগামী নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করবেন সে সব কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ইতিহাস আমাদের নতুন করে একটি সুযোগ দিয়েছে। অন্য জেনারেশন এই সুযোগ পাবে না। আপনাদের প্রধান দায়িত্ব হলো একটি শান্তিপূর্ণ ও আনন্দমুখর নির্বাচন আয়োজন করা।
তফসিলের আগে সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর সারা দেশের মাঠপর্যায়ের সব নির্বাচনী কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন নির্বাচন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচন কমিশনের বিগত সময়ের কার্যক্রমে হারানো ইমেজ আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করতে হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে। কেউ কোনো অনিয়মের সাথে জড়িত হলে প্রমাণ পেলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমনকি পরবর্তীতে আর কোনো দায়িত্বে অনিয়মকারী কর্মকর্তাকে রাখা হবে না। এককথায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যা যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে।
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় এবং নির্বাচনে কমিশনে দলটির নিবন্ধন স্থগিত থাকায় ভোটের বাইরে থাকতে হচ্ছে দলটিকে। এমনকি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীর ফলে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাসহ দলটির পলাতক অনেক নেতা ইতোমধ্যে নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে গেছেন। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটের শরিক নিবন্ধিত দলগুলো চাইলে এ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ অংশ নিতে না পারলেও আসন্ন নির্বাচনে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি হবে। অন্তর্বর্তী একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে কমবেশি ৭০ শতাংশ ভোট পড়বে। বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে না পারা প্রায় তিন কোটি তরুণ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য মুখিয়ে আছেন।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, নতুন তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে দেশে মোট ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ছয় কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ জন, নারী ছয় কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) ভোটার এক হাজার ২৩৪ জন। সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়ায় এবার একই ভোটকক্ষে দুটি করে ভোট দেয়ার স্থান নির্মাণ করা হচ্ছে। যেসব ভোটকক্ষে দুটি গোপন স্থান নির্মাণের অবকাঠামো সুবিধা নেই সেসব কেন্দ্রে বাড়তি ভোটকেন্দ্র করা হবে। এই হিসাবে নির্বাচনে ভোটকক্ষের সংখ্যা আরো বাড়বে। ইসির তথ্যানুযায়ী, এবার সংসদ নির্বাচনে চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ৭৬১টি এবং ভোটকক্ষ দুই লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯টি।
এর মধ্যে পুরুষদের জন্য এক লাখ ১৫ হাজার ১৩৭ এবং মহিলাদের জন্য এক লাখ ২৯ হাজার ৬০২ কক্ষ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে পুলিশ, বিজিবি এবং আনসারসহ প্রায় সাত লাখ ৬৮ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যদিকে, নির্বাচনের সময় প্রায় ৮০ হাজার সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হবে। নির্বাচনে অন্যান্য প্রস্তুতির মধ্যে এ কমিশন নতুন রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক নিবন্ধন, আইন সংস্কার, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও প্রবাসীদের সুবিধার্থে আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি চালু করেছে। সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আদালতে ৩০টির বেশি রিট থাকলেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে জটিলতা দেখছে না কমিশন।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, তফসিল ঘোষণার পর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কাজ ইসি শুরু করবে। এ নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ। প্রত্যেক কাজের জন্য, দেশের স্থিতিশীলতার জন্য, দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য, দেশের উন্নয়নের জন্য আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ দরকার। আসন্ন নির্বাচনে নিরাপত্তা বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছি।