Image description

দেশে হঠাৎ করেই বেড়েছে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড। এর বেশির ভাগ টার্গেট কিলিং। রাজনৈতিক উত্তেজনা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক সংঘর্ষ, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা এবং পারিবারিক সহিংসতাই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে গড়ে দৈনিক ১১ জন খুন হচ্ছে। এসব ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে দাবি করছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা।

গত ৩০ নভেম্বর খুলনা আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়া দুই বিচার প্রার্থীকে আদালত প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, একটি মামলার আসামি হিসেবে হাজিরা দিয়ে আদালত থেকে বাইরে বের হওয়া মাত্রই একাধিক গুলির পর কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা।

এর আগে ১০ নভেম্বর পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে তারিক সাইফ মামুন নামে এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনিও মামলার হাজিরা দিতে আদালতে গিয়েছিলেন। একসময় ঢাকার ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগী ছিলেন হত্যাকাণ্ডের শিকার মামুন। অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে মামুনকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশের দাবি। আদালতের মতো একটি নিরাপদ জায়গায়ও প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সাধারণ মানুষ।

১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকে একটি হার্ডওয়্যার অ্যান্ড স্যানিটারির দোকানে ঢুকে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের ১৬ নম্বর সড়কে চার তরুণকে পেটানো হয়। এ ঘটনায় সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ মারা যান। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির গভীর সঙ্কটকে স্পষ্ট করেছে।

তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে এটি টার্গেট কিলিং কিনা সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আরো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটেসহ রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে কোনো দুষ্টুচক্র এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এর আগে প্রতিবেশী দেশে পলাতক পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করতে তাদের সহযোগীদের নির্দেশ দিয়েছে। এ জন্য মোটা অঙ্কের টাকাও আসছে বিদেশ থেকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা শুধু ব্যক্তিগত টার্গেট নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি আঘাত। দেশে এ মুহূর্তে সব থেকে উদ্বেগের বিষয় হলো ‘টার্গেট কিলিং’।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত খুন হয়েছে তিন হাজার ২৩০ জন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ জন খুন হয়েছে। সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে জুলাই মাসে: ৩৬২টি। বিপরীতে সবচেয়ে কম খুন হয়েছে জানুয়ারিতে: ২৯৪টি। দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি এতই নাজুক যে, গত ১০ মাসে খোদ রাজধানীতেই ১৯৮টির বেশি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে প্রকাশ্যে গুলি করে বা কুপিয়ে।

বিভাগওয়ারি খুনের হিসাবে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি রাজধানীকেন্দ্রিক ঢাকা বিভাগে, এক হাজার ১৮৬টি। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ৬০৩টি, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে ৩২৫টি করে, রংপুরে ২২৩টি, ময়মনসিংহে ২০২টি, সিলেটে ১৯৩টি এবং বরিশালে ১৬২টি খুনের ঘটনা ঘটে।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের একই সময়ে খুন হয়েছিল তিন হাজার ১৭ জন, আর ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৫৬৩ জন। অর্থাৎ: ২০২৪ সালের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে খুন বেড়েছে ৭ শতাংশ, আর দুই বছরের ব্যবধানে বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ শতাংশ। আদালতের মতো একটি নিরাপদ জায়গায়ও যখন প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে তখন সারারণ মানুষ আসলে কোথায় নিরাপদ, এমন প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকা ও খুলনার আদালতপাড়ায় প্রকাশ্যে খুনের পর দেশের সব অধঃস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

শুধু ঢাকাতেই নয়, চট্টগ্রাম পুলিশের দেয়া তথ্যানুয়ায়ী, খোদ চট্টগ্রামের রাউজানেই ছয়টি টার্গেট কিলিং গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। যেখানে ৭ অক্টোবর হাটহাজারীর মদুনাঘাট ব্রিজের কাছে একদল লোক প্রাইভেটকার আটকে রাউজানের ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমকে গুলি করে হত্যা করে। চালিতাতলীতে আসন্ন নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। ওই হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা।

কুমিল্লা সদর উপজেলায় মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করায় গত ১৭ নভেম্বর রাহেলা বেগম ও তার ছেলে কামাল হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা।
খুলনা মহানগরীতে গত ১৪ মাসে ৪৪টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব খুনের মধ্যে শুধু মাদককে কেন্দ্র করেই কম হলেও ২০টি খুন হয়েছে। সেখানে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপকহারে। মাদকের বিস্তার নিয়ে প্রভাব খাটাতেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের মূল হোতারা অস্ত্র কিনতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। বিশেষ করে ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে তারা এসব অস্ত্র নিয়ে আসে বলে জানায় গোয়েন্দা সংস্থা। গত ১৪ মাসে ৪০টির মতো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে চট্টগ্রামে।

দেশের এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর তৎপরতা জরুরি। জননিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো আপস নয়। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার এবং সন্ত্রাস দমনে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। নয়তো মহল্লাভিত্তিক এ গ্যাং সংস্কৃতি দেশ ও দেশের মানুষকে গভীর নিরাপত্তা সংকটে ফেলবে বলে অপরাধ বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে বিদ্যমান সমন্বয়হীনতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অসহযোগিতা, অভিযুক্ত বা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বা অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ বা গ্রহণে বিলম্ব অপরাধীদের নানাভাবে সহিংস করছে।

পুলিশ সদর দফতরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, সম্প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত আক্রোশ বা দ্বন্দ্বের কারণেই হত্যার ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া দেশে নির্বাচনী বছরে সহিংসতা স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে। এবারো সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। তবে আমরা এরই মধ্যে নির্বাচনের আগে, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি নিয়েছি।