Image description

কয়লার দাম নির্ধারণ নিয়ে প্রায় এক বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্তৃপক্ষের (বিসিএমসিএল) মধ্যে টানাটানি চলছে।

এক কোম্পানির বাড়তি মূল্য দাবির বিপরীতে অপর প্রতিষ্ঠানের তরফে জোর আপত্তি দেওয়া হয়েছে। এতে মূল্য নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা কাটেনি, যা নিরসনে কাজ করছে জ্বালানির বিভাগের নতুন একটি কমিটি। আগের একটি কমিটি দীর্ঘ সময় নিয়েও যেটির সুরাহা করতে পারেনি।

অনেক বেশি দামে দেশের একমাত্র উত্তোলন হওয়া কয়লার খনি থেকে কয়লা কিনতে বাধ্য হওয়ায় অর্থ সংকটে থাকা পিডিবিকে গত তিন বছরে ৩০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে।

দেশের প্রধান এই বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি মূল্য গোনার বিপরীতে বিসিএমসিএল বড় অঙ্কের মুনাফা করেছে। কোম্পানির ১৮১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী গত চার বছরে প্রত্যেকে ৫৭ লাখ টাকা করে লভ্যাংশ পেয়েছেন।

বাড়তি ব্যয়ের চাপ সামলাতে পিডিবি জানুয়ারি থেকে আগের মত উচ্চমূল্য দেওয়া বন্ধ করে আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী দাম দিচ্ছে, যা বিসিএমসিএলের দাবি করা দরের চেয়ে ৭৭ শতাংশ কম।

“আমরা তাদের বেঁধে দেওয়া দাম দিচ্ছি না। ওই দামে তাদের লাভ হলেও আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে,” বলেন পিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম।

তিনি বলেন, বিষয়টির সমাধানে সংশ্লিষ্টরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে আগামী ৩১ ডিসেম্বর হতে যাওয়া বিসিএমসিএলের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) বাতিল করা হয়েছে।

কোম্পানির এমডি আবু তালেব ফারাজি বলেন, নতুন দাম নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত এজিএম স্থগিত থাকবে।

 

 

দেশের পাঁচটি কয়লা খনির মধ্যে একমাত্র বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলন করা হয়। এ খনিতে মজুদের পরিমাণ অনুমানিক ৩৯ কোটি টন।

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্তৃপক্ষের টনপ্রতি ১৭৬ ডলার করে দাম পরিশোধ বন্ধ করার পর থেকে এ আলোচনা ইতিমধ্যে এক বছর ধরে চলছে, যা নিয়ে কাজ করছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, যেটির অধীনে এ দুই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।

ভ্যাট ও কর বাদ দিয়ে দেশের এ খনি থেকে উত্তোলিত কয়লার জন্য বিসিএমসিএল এখনও প্রতি টনে ১৭৬ ডলার করে দাবি করছে। ২০২২ সাল থেকে এ দরই পেয়ে আসছিল দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় স্থাপিত এ খনি কর্তৃপক্ষ।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি এ দর অনুমোদন করে। তখন জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। এমনকি তখন ভূতাপেক্ষভাবে এক বছর আগে ২০২২ সাল থেকে তা পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়।

তবে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্তৃপক্ষের দাবি করা দর আন্তর্জাতিক বাজারের সবচেয়ে ভালো মানের কয়লার চেয়েও অনেক বেশি। ইন্দোনেশিয়া থেকে এখন টনপ্রতি ১২৭.৭২ ডলারে সবচেয়ে ভালো মানের কয়লা পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশ এখন কয়লার প্রধান উৎস। সেখা থেকে পরিবহন ও ওঠানামা খরচ বাদ দিয়েই ৭২ দশমিক ২৪ থেকে ৯২ দশমিক ৮৭ ডলারের মধ্যে এখন কয়লা কিনছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

 

বিসিএমসিএল ৬,১৩৭ কিলোক্যালরি/কেজি মানের কয়লা উৎপাদন করে, যা ইন্দোনেশিয়া থেকে কেনা সর্বোত্তম মানের কয়লার প্রায় সমান। তবে তাদের দাবি করা দাম এখন অনেক বেশি। আর দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আমদানির ক্ষেত্রে দাম সাশ্রয়ে উচ্চ মানের বদলে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করে।

এত উচ্চ দরে কয়লা কেনার প্রেক্ষাপটে পিডিবির অভ্যন্তরীণ এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বড়পুকুরিয়ায় খনি থেকে কয়লা তুলতে প্রতি টনে ব্যয় হয় ৮৫ ডলার। অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে তা কোম্পানির মুনাফা হিসেবে থাকে। পিডিবি এ কয়লার একমাত্র ক্রেতা। বড়পুকুরিয়ায় স্থাপিত কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে তা ব্যবহার করা হয়।

তবে বিএমসিএলের দাবি, তাদের উৎপাদন খরচ গিয়ে ঠেকে প্রতিটন ১৩৮ ডলারে।

অন্যান্য কেন্দ্রের কয়লা ব্যবহারের তথ্য বিশ্লেষণে পিডিবির কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, আমদানি করা কয়লা ব্যবহার করে বড়পুকুরিয়ার মত একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করলে প্রতি টন কয়লার খরচ ১২৬ ডলারের বেশি হত না।

বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম বেশি কেন?

দিনাজপুরের এ খনির ওপর নির্ভর করে সেখানে ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে পিডিবি। এ খনির প্রধান ক্রেতাও তারা। এ কারণে কয়লার দাম বেশি হলে এর চাপ পড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ে।

আগের তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, পিডিবি আগে মূল্য বাড়ানোকে ন্যায়সঙ্গত বলে সমর্থন করেছিল। তবে এখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কমমূল্যে পাওয়া যাওয়ায় এত বেশি দাম দিতে রাজি নয়।

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্তৃপক্ষ দাম নির্ধারণের প্রস্তাবে উৎপাদনের জন্য প্রতি টনে ১৩৮ ডলার ব্যয় এবং ভূমি অধিগ্রহণ ও ভবিষ্যৎ অনুসন্ধানের জন্য প্রায় ৫০ ডলার যুক্ত করেছিল। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের ওই সময় বলেছিলেন, ভূমি অধিগ্রহণ ও অনুসন্ধানের খরচ মুনাফা থেকেই ব্যয় করা উচিত।

প্রস্তাবিত মূল্যে ভ্যাট ও অন্যান্য কর পরিশোধের পর ১৫ শতাংশ মুনাফাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন প্রতি টন ১৭৬ ডলার ধরে দর নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর আগের দর ছিল প্রতিটন ১৩০ ডলার।

কী বলছে বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ

কয়লার দর নির্ধারণে জ্বালানি বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণ করার কথা তুলে ধরে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু তালেব ফারাজি বলেন, তাদের দাবি অনুযায়ী পিডিবি কয়লার দাম পরিশোধ করছে না। তারা বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারদর ধরে দাম দিচ্ছে। আংশিক পরিশোধের কারণে পিডিবির কাছে তারা গত এক বছরে ১১০ কোটি টাকা পাবেন।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারদরের ভিত্তিতে পিডিবি টনপ্রতি কয়লার জন্য ৯৪ থেকে ১০৬ ডলার পরিশোধ করছে।

কয়লার দর প্রতি টনে ১৭৬ ডলার নির্ধারণের পর থেকে তাদের ধারাবাহিক মুনাফা বাড়তে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, মুনাফার একটি অংশ ১১০ কোটি টাকা ১২১ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে ব্যয় করার কথা ছিল। তবে এই অর্থ এখনও বিনিয়োগ করা হয়নি। তা কোম্পানির মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়েছে।

ভূমি অধিগ্রহণে অর্থ ব্যয় না হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান এমডি।

তিনি বলেন, কোম্পানির সম্প্রসারণ বা উৎপাদন বাড়াতে মুনাফা থেকে বিনিয়োগ করা হয়। এ বছর উৎপাদনের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ৯ লাখ টন হলেও তা ১০ লাখ টনে পৌঁছেছে।

এমডি বলেন, প্রতিবছর মুনাফার ৫ শতাংশ কর্মীদের দিযে থাকে বিসিএমসিএল।

চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা তোলার কাজ করছে। খনন কার্যক্রম চালঅতে ২০২৭ সাল পর্যন্ত তাদের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে।

১৯৮৫ সালে কয়লাক্ষেত্রটি আবিষ্কারের পর থেকে এ কোম্পানির সঙ্গেই কয়লা উত্তোলনের কাজের চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছে।

এ খনিতে ২০০৫ সালে কয়লা তোলা শুরুর পর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ১ কোটি ৩০ লাখ টন উত্তোলন করা হয়েছে। এরমধ্যে মধ্যে ৯৫ লাখ টন পাশে স্থাপিত ৫২৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়েছে। বাকি ৩৩ লাখ টনের বেশি স্থানীয় শিল্পে সরবরাহ করা হয়েছে।

নতুন দর নির্ধারণে কমিটি

জ্বালানি বিভাগের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে নয় সদস্যের একটি কমিটি নতুন দর নির্ধারণে কাজ করছে। সবশেষ এ কমিটি গঠন করা হয় গত ১১ নভেম্বর। এর আগে এ বিষয়ে গঠিত আরেকটি কমিটি দর নির্ধারণ করতে স্পষ্টত ব্যর্থ হয়।

নতুন এ কমিটি একই সঙ্গে বকেয়ার বিষয়টিও সুরাহা করবে। কমিটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমদানি করা কয়লা এবং স্থানীয়ভাবে উত্তোলিত কয়লা ব্যবহারের খরচ তুলনা করে এ দর নির্ধারণে কাজ করছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।

কমিটি বাড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করে সেগুলোর জ্বালানি দক্ষতাও পরীক্ষা করবে।

এসব বিষয়ে কথা বলতে জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে ফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।