অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে বড় পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পাচার করা অর্থ বা সম্পত্তি অধিকারে রাখার ক্ষেত্রে প্রমাণের দায়ভার যাচ্ছে অভিযুক্তের কাছে। প্রচলিত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে বাদীকে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত হাজির করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করতে হয়। সেখানে সংশোধিত অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, অর্থ পাচারের মামলা হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে– তিনি পাচারের সঙ্গে জড়িত নন। তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে না পারলে আদালত অনুমান করে নেবেন– তিনি মানি লল্ডারিংয়ের অপরাধ করেছেন। এর ভিত্তিতে আদালত দণ্ড দেবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নতুন এ বিধান সংযোজন করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংসদ না থাকায় রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।
খসড়ায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ধারা ৯-এর পর নতুন ধারা ‘৯ক’ সন্নিবেশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এভিডেন্স অ্যাক্ট-১৮৭২ এবং এ আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছু থাকুক না কেন; কোনো ব্যক্তি বা সত্তা বিদেশে পাচার করা কোনো অর্থ বা সম্পত্তি তাঁর নিজ নামে বা তাঁর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তির নামে অথবা তাঁর দখলে রাখলে আদালত অনুমান করে নেবেন– অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সত্তা মানি লন্ডারিং অপরাধে দোষী। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি আদালতের অনুমান খণ্ডন করতে না পারেন, তাহলে ওই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া কোনো দণ্ড অবৈধ হবে না।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এ সমজাতীয় একটি উপধারা আছে। আইনটির ২৭ ধারার উপধারা-২-এ বলা হয়েছে, বিচার চলাকালে যদি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পত্তির বিষয়ে এমন প্রমাণ মেলে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজ নামে বা তাঁর পক্ষে অপর কোনো ব্যক্তির নামে তাঁর জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন করেছেন বা দখলে আছে, তাহলে আদালত অনুমান করবেন– অভিযুক্ত ব্যক্তি ওই অপরাধে দোষী। যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে ওই অনুমান খণ্ডন করতে না পারেন, তাহলে ওই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া কোনো দণ্ড অবৈধ হবে না।
আইন অনুযায়ী, অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে প্রাপ্ত অর্থের উৎস গোপন বা গোপন করার চেষ্টা করার প্রক্রিয়া হিসেবে বা বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি বিদেশে পাচার করার কার্যকলাপকে সাধারণভাবে ‘মানি লন্ডারিং’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। অপরাধের অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে পাঠানো বা আনা যদি অবৈধ উৎস লুকানোর উদ্দেশ্যে করা হয়, তাও মানি লন্ডারিংয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়।
মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়া সাধারণত তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়– স্থানান্তর, স্তরায়ন ও একীকরণ। স্থানান্তর হলো প্রথম ধাপ, যেখানে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বৈধ আর্থিক ব্যবস্থায় প্রাথমিকভাবে জমা বা প্রবেশ করানো হয়।
স্তরায়ন হলো অর্থের উৎস গোপন করার প্রক্রিয়া, যা একাধিক লেনদেনের মাধ্যমে করা হয় এবং যার মধ্যে বেশির ভাগই অপ্রয়োজনীয় ও হিসাবনিকাশের কারসাজি। কখনও কখনও স্তরায়ন লেনদেনের কাঠামোগত পদ্ধতির মাধ্যমেও হয়।
একীকরণ হলো চূড়ান্ত ধাপ। এ ধাপে বৈধ মনে হওয়া অর্থ তখন ব্যাংক হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয় এবং অপরাধীরা তাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী এর ব্যবহার করে, যা ওই অর্থকে দৃশ্যত বৈধ করে তোলে। তাই অপরাধী চিহ্নিত হওয়ার পরও অকাট্য তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অর্থ পাচার প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক সমকালকে বলেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন নিয়ে অংশীজনের সঙ্গে বৈঠকে সুপারিশের ভিত্তিতে খসড়া তৈরি করা হয়েছে। অংশীজনের সঙ্গে আরও আলোচনার ভিত্তিতে অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করা হবে। নতুন বিধান যুক্ত করে বাস্তবায়ন করা গেলে এ-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সহায়ক হবে বলে মনে করছে সরকার।
মানি লন্ডারিং নিয়ে কাজ করেন এমন কর্মকর্তারা জানান, অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে অধিকাংশ লেনদেনই স্তরে স্তরে হয়ে থাকে। সাধারণভাবে প্রথমে ট্যাক্স হ্যাভেন বা কর স্বর্গ হিসেবে পরিচিত দেশে অর্থ নিয়ে সেখান থেকে অন্য দেশে পাচার করা হয়। বিভিন্ন দেশে সম্পদের তথ্য গোপনীয়তার আইন কঠোর হওয়ায় অর্থ পাচার প্রমাণ করাও কঠিন। এই বাধা পেরোতে আইন সংশোধন করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই অভিযোগ খণ্ডনের দায়ভার দেওয়া হচ্ছে।
পাচারকারী দেশের বাইরে থাকলে কী হবে
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, পাচারকারী দেশের বাইরে থাকলেও আইনি প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে আদালতে উপস্থিত হয়ে অভিযোগ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করতে হবে– তিনি পাচার করেননি। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি আদালতে উপস্থিত না হন বা বিচারকার্যে অংশ না নেন, তাহলে আদালত অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিতে পারবেন। তিনি এও বলেন, এ ধরনের আইনের অপপ্রয়োগের ঝুঁকি থাকে। নির্দোষ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি এ আইনে মামলা হয় এবং যৌক্তিক কারণে তিনি আদালতে হাজির হতে না পারেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তির রায় হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের অনেক দেশে মানি লন্ডারিং আইনে এ ধরনের ধারা নেই। তবে ভারতসহ বেশকিছু দেশে আইনে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার চেষ্টার অংশ হিসেবে এ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ও সম্পদ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইজারল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশে গেছে বলে সরকার বিভিন্ন সময় বলেছে। ওইসব দেশের আইনে যদি এমন ধারা না থাকে তাহলে তারা অর্থ ফেরত দিতে সম্মত হবে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের দেশে এ ধরনের আইন না থাকলেও যেসব দেশে আছে, সেসব দেশে এমন রায় আমলে নেওয়ার নজির আছে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, অভিযুক্তকে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে শাস্তি দেওয়া অগ্রহণযোগ্য বিবেচ্য হওয়াই যৌক্তিক। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিধানের পেছনে যুক্তি যদি হয় পাচার করা অর্থ ফেরত আনার সম্ভাবনা সহজতর করা, তাহলে তা কীভাবে এবং কী ধরনের শর্ত সাপেক্ষে করা হবে, সেটি সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সেটি কি প্লি-বারগেইন (অপরাধ স্বীকারের মাধ্যমে আসামির শাস্তি কমানোর বোঝাপড়া) এর মতো পদ্ধতি? সে ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো নিশ্চিত করতে না পারলে তা বাস্তবে অর্থ পাচারের বৈধতার ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সম্ভাব্য ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে পর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ছাড়া এ ধরনের অস্থায়ী উচ্চাভিলাষ অর্থ পাচারের শাস্তিকে ঢালাওভাবে বিচারহীনতার তকমা দেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধার প্রক্রিয়ায় অন্তর্নিহিত জটিলতা সম্পর্কে সম্যক কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যথাযথ পরামর্শ সাপেক্ষে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বিচার যেভাবে হচ্ছে
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ৬টি সংস্থাকে মানি লন্ডারিং অপরাধের তদন্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এসব সংস্থা হলো– অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।
মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলার বিচার করার এখতিয়ার কেবল বিশেষ জজ আদালতের। মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত উল্লিখিত ২৭ ধরনের অপরাধ করা কিংবা করার চেষ্টা, সহায়তা করা কিংবা ষড়যন্ত্র করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর, সর্বনিম্ন তিন বছর কারাদণ্ড। আর এভাবে অর্জিত সম্পদের দ্বিগুণ কিংবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা করতে পারবেন আদালত। মানি লন্ডারিং অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে পারেন আদালত।
ফেরত আনায় সাফল্য নেই
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ও সম্পদ অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। সে হিসাবে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।
এ অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে বলে একাধিকবার বলেছে সরকার। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ১৯টি পারস্পরিক আইনি সহায়তার অনুরোধ পাঠিয়েছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ও সম্পদ উদ্ধারের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সাফল্য এখনও পাওয়া যায়নি।