Image description

যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের আবেদন বাড়ছে। আশ্রয়ের আবেদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রত্যাখ্যানের হার। বিভিন্ন দেশের কঠোর অভিবাসন নীতি, মিথ্যা তথ্য দিয়ে আশ্রয় আবেদনের হার বৃদ্ধির কারণে প্রত্যাখ্যানের হারও বেড়েছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও দেশে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করলে এই হার বেড়ে যায়, এটি নতুন কিছু নয়। তবে এর সঙ্গে তরুণদের বেকারত্বের হার বৃদ্ধির একটা সম্পর্কও আছে বলে মনে করেন তারা। আবার মিথ্যা তথ্য দিয়ে আশ্রয় আবেদনের কারণে বাংলাদেশিদের আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার বেশি বলে মনে করেন তারা। এতে যাদের প্রকৃত আশ্রয়ের প্রয়োজন, তারা পড়ছেন বিপদে।       

যুক্তরাজ্যে আশ্রয় আবেদনের শীর্ষে বাংলাদেশ 

যুক্তরাজ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে আশ্রয়ের আবেদন করেছেন ১ লাখ ১০ হাজার ৫১ জন, যা গত বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। যে পাঁচটি দেশের নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি আশ্রয়ের আবেদন করেছেন তাদের মধ্যে আছে পাকিস্তান, ইরিত্রিয়া, ইরান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন বিভাগ বলছে—প্রতি পাঁচ জন আশ্রয় আবেদনকারীর মধ্যে দুই জন এই পাঁচ দেশের নাগরিক—যা মোট আবেদনকারীর ৩৯ শতাংশ। গত ২৭ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন বিভাগ এই হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ২২ হাজার থেকে ৪৬ হাজার লোক যুক্তরাজ্যে আশ্রয়ের দাবি করেছিল। এরপর ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে। সাম্প্রতিক বছরটি রেকর্ডে সর্বোচ্চ, যা ১৯৭৯ সালের মতো এবং ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

ইউকে বর্ডার কন্ট্রোল বলছে, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আশ্রয়ের আবেদন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও বেড়েছে এবং উভয় দেশ থেকে বেশিরভাগ দাবিদার আশ্রয় দাবি করার আগে ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছে। অভিবাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের পরে ভারতসহ এই নাগরিকদের ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ওয়ার্ক এবং স্টাডি ভিসার মাধ্যমে প্রবেশের একটি বড় বৃদ্ধি দেখা গেছে। পরিসংখ্যান বলছে, এদের একটি বড় সংখ্যা তরুণ।

ইউরোপে আশ্রয় আবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়

ভেনেজুয়েলান এবং আফগানরা ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে আশ্রয় প্রার্থীদের বৃহত্তম গোষ্ঠী ছিল। ইউরোস্ট্যাটের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনে আশ্রয় আবেদনকারীদের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম সংখ্যার নাগরিক ছিল বাংলাদেশের। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জুনে ২ হাজার ৭৩৫টি আবেদন জমা পড়েছে, যা গত বছরের জুনের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ কম। 

ইউরোপে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন ৯৬ শতাংশই খারিজ

ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৫৫০ জন বাংলাদেশি নাগরিক প্রথমবার আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। আর ২০২৪ সালে বাংলাদেশিদের আবেদন সফল হওয়ার হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশিদের ৪৫ হাজার ১২৯টি আবেদন নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ ছিল।

ইইউ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুনে ফ্রান্স, ইতালি এবং গ্রিস অভিবাসীদের আবেদন নিষ্পত্তির হার বাড়িয়ে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, আবেদন নিষ্পত্তির গতি বাড়লেই বাংলাদেশিদের ফেরত আসাও বৃদ্ধি পাবে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশিদের আশ্রয় আবেদন বাড়ছে প্রতি বছর  

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী মর্যাদা প্রত্যাশী বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গত পাঁচ বছরে ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত, বিদেশে আশ্রয় প্রার্থী বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রতি বছর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখিয়েছে।

শুধু ২০২৪ সালে ২৮ হাজার ৪৭৩ জন বাংলাদেশি জাতিসংঘে শরণার্থী হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছিল। উপরন্তু, একই বছরে ১ লাখ ৮ হাজার ১৩১ জন বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। এই ব্যক্তিদের বেশিরভাগই ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন দেশে শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছে।

ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য বলছে, আশ্রয় আবেদন করা ব্যক্তিরা যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, সাইপ্রাস, বসনিয়া এবং অস্ট্রিয়ার মতো ইউরোপীয় দেশগুলোতে নিবন্ধিত হয়েছেন। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর ও পাপুয়া নিউগিনিতে আশ্রয় চেয়েছেন।

এশিয়ায় তারা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া এবং হংকংয়ের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে নিবন্ধিত হয়েছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০২৪ সালে পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়ায় ছয় জন বাংলাদেশি শরণার্থী হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছিলেন।

২০২৩ সালে ২৪ হাজার ১২৬ জন বাংলাদেশি জাতিসংঘে শরণার্থী হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছিল, এর আগে ২০২২ সালে সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৯৩৫, ২০২১ এই সালে ২২ হাজার ৬৭২, ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৯৪৮, ২০১৯ সালে ২২ হাজার ৭৬৬, ২০১৮ সালে ২১ হাজার ২২ এবং ২০১৭ সালে ১৬ হাজার ৭৮০ জন ছিল।

২০২৩ সালে ৭৫ হাজার ৮৬৭ জন বাংলাদেশি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন। এর আগে ২০২২ সালে ৬১ হাজার ২৯৮ জন, ২০২১ সালে ৬৫ হাজার ৪৯৫ জন এবং ২০২০ সালে ৬৪ হাজার ৬৩৬ জন, ২০১৯ এবং ২০১৮ সালে ৬২ হাজার ৮৬০ জন বাংলাদেশি বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ সীমিত অভিবাসন, অর্থনীতিকসহ নানা কারণে আশ্রয় আবেদন বৃদ্ধি পায়। তবে এটি নতুন নয়।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘ট্রেন্ডটা বাড়ার একটা কারণ হচ্ছে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল, এটা যেকোনও দেশেই হয়। অনেক সময় আমাদেরও হয়েছে—কোনও সময় একটা সরকার বদল হলে তখন হয়তো সত্যিকার কারণে, তারা হয়তো নির্দিষ্ট দল করতো সেটা, আবার অনেকের সুযোগও নাই সেটাও আছে। এইটা অনেক আগে থেকেই হয়েছে। শুধু ইউরোপের জন্য তো ওটা একটাই যে ওখানে অনেক ধরনের হিউম্যান রাইটসের জায়গা থেকে তারা সেই সুযোগটা নিয়ে থাকে। কিন্তু অনেকে এটাকে অপব্যবহার করে, সেটা হচ্ছে একটা জায়গা। আরেকটা হচ্ছে, পুরো ইউরোপের তো বিভিন্ন রকম পলিসি পরিবর্তন হচ্ছে। কোনও দেশ এই জায়গায় স্কিল মাইগ্রেশনের কথা বলে। যেমন- ইটালি এমনিতে একটু কঠোর হচ্ছে যে অনিয়মিত পথে যারা যাচ্ছে ডকুমেন্টেশন ছাড়া। আবার তারা প্রমোট করছে যে স্কিল মাইগ্রেশন হোক, স্কিল লোকজন যাক।’’

তিনি বলেন, ‘‘কোনও কোনও সরকার তাদের ডাইভার্সিটির কারণে মনে করছে যে তারা অন্যান্য জায়গা থেকে নেবে। আর আল্টিমেটলি আমরা পজিটিভ বলি আর নেগেটিভ বলি, যেমন- আমরা বলি যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, আমাদের জনসংখ্যা এত বেশি যে সেটা একটা পজিটিভ জায়গা। আমাদের তরুণ জনসংখ্যা অনেক বেশি। অর্থাৎ প্রোডাক্টিভ ওয়ার্কফোর্স একটা আছে। তাদের আবার নেগেটিভ জায়গাটা হচ্ছে—আমাদের দেশে তাদের সবার চাকরি নাই।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘অ্যাভারেজ মিডল ক্লাস ছেলেপেলে কম্পিটিশনে এখানে তেমন সুবিধা করতে পারছে না। আবার তারা যে বিদেশে অ্যাপ্লাই করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে, স্কলারশিপ পাবে সে গ্যারান্টিও নাই। তো তাদের পরিবারের ওরকম অবস্থাও নাই যে তারা তাদের সাপোর্ট করবে। এই শ্রেণির মানুষগুলো মনে করছে—ঠিক আছে যেকোনোভাবে যদি যাওয়ার একটা সুযোগ করা যায়। এখন স্টুডেন্ট ভিসাও কিন্তু রেস্ট্রিক্টেড হয়ে যাচ্ছে। তো সেই জায়গা থেকে ওরকমই হয়তো স্টুডেন্ট ভিসা যদি শেষ হয়ে যায়—তখন একটা যুক্তি দেখিয়ে অ্যাসাইলাম চায়। এই কয়েকটা কারণ আমার মনে হয় যে আছে। এটা মানে নতুন না সেই অর্থে এবং এটা যে আবার কমে যাবে না তাও না। এটা অবজার্ভ করতে হবে যে কমে কিনা। আর যেসব দেশে তারা সিক করছে, সেসব দেশে তো আসলে মানে এমন না যে অ্যাসাইলাম চাইলেই তারা পাবে। বেশিরভাগই রিজেক্টেড হবে। দেখা যাবে—ওইটাও তখন অনেকে জানতে পারবে যে আচ্ছা আমরা অনেকেই ট্রাই করছে কিন্তু পাচ্ছি না। কাজেই জেনুইন কেস না হলে অবশ্যই তারা দেবে না এবং জেনুইন কেসের জন্য তাদের কাগজপত্র দেখাতে হবে। তাদের জেনুইন রিজন কী, সে যদি বাংলাদেশি হয়, এখন বাংলাদেশে তো তাকে প্রমাণ করতে হবে যে আমি বাংলাদেশে থাকতে পারছি না। আমার জীবন সংকটাপন্ন যেকোনও কারণে হোক, হতে পারে ধর্মীয় পরিচয় কিংবা অন্য কোনও একটা স্পেশাল আইডেন্টিটি তার আছে—এগুলো তাকে প্রমাণ করতে হবে যে এগুলোর কারণে বাংলাদেশে থাকা আমার জন্য রিস্ক। তো সেটা করতে না পারলে তো ম্যাক্সিমাম হবে, তখন দেখা যাবে ট্রেন্ড আস্তে আস্তে আবার কমে আসে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ যখন একটু স্থিতিশীল হবে, তখন কিছু চেঞ্জ হয়ে বা কিছু করে তারপরে আবার একটা রেগুলার জায়গায় চলে আসতে পারে।’’

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে আশ্রয় নিতে চায়, তাদের সবার রাজনৈতিক কারণ থাকে, তা কিন্তু না। এদের রাজনৈতিক কারণের চেয়ে অনেক বেশি থাকে—অনিয়মিত পথে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে, কিংবা ব্রাজিল থেকে মেক্সিকো হয়ে তারা অনিয়মিত পথে বিদেশ চলে যায় এবং গিয়ে তারা এটা ইউরোপে হোক, কিংবা যুক্তরাজ্যে হোক, কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে— তারা রাজনৈতিক আশ্রয় চায়।’’

তিনি বলেন, ‘‘ফলে দেখা যায়—তাদের ইউরোপে বলি কিংবা যুক্তরাজ্যে, তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার অনুমোদন যদি বলি—সেটা এক শতাংশের কম। এর অর্থ এই, তাদের কাগজপত্র কিছুই ঠিক নাই, তারা মূলত অবৈধভাবে ঢুকে একটা কাগজ দিয়ে দেয়। আবেদন করে যে লম্বা সময় ধরে থাকতে পারবে। এটা বছরের পর বছর চলছে। সেই কারণে সত্যিকারের বিপদে পড়া বা সত্যিকারের রাজনৈতিক আশ্রয় বা সত্যিকারের কারণ আছে—এরকম কেউ যখন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে বাংলাদেশ থেকে, তারা কিন্তু বিপদে পড়ে। কারণ তখন ধরেই নেওয়া হয় যে বাংলাদেশের আবেদনগুলো ভুয়া। এই কারণে বাংলাদেশের আবেদন বেশি প্রত্যাখ্যান হচ্ছে।’’