পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ শিবলী কায়সার। ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা। প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। পরে হন সহসভাপতি। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গর্ব করেই নিজের রাজনৈতিক আদর্শের কথা প্রচার করতেন। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পর ভোল পালটে তিনি রাতারাতি বনে যান ফ্যাসিস্টবিরোধী। বাগিয়ে নেন গুরুত্বপূর্ণ পদ-হন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরপিএমপি) উপকমিশনার (ডিসি)। সেখানে যাওয়ার পর পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের এক সহযোগীর মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেন এক ব্যবসায়ীর কাছে। বিনিময়ে ওই ব্যবসায়ীকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে তদন্তে নামে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। তদন্তে ঘুস গ্রহণসহ আরও বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এরই মধ্যে তাকে করা হয়েছে সাময়িক বরখাস্ত।
তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, গত ১৩ মার্চ রংপুর কোতোয়ালি থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন পলাশ হাসান নামে এক ব্যক্তি। ঘুস দাবির ওই মামলায় নাম ছিল এসপি মোহাম্মদ শিবলী কায়সারের। শিবলী তখন ছিলেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি। এজাহারে তার নাম আছে-এই খবর জানার পর থানায় ছুটে যান শিবলী। আকস্মিকভাবে ঢুকে পড়েন থানার কম্পিউটার রুমে। সেখানে এজাহারের কপি সংশোধন করছিলেন ওসি আতাউর রহমান ও মামলার বাদী পলাশ হাসান। হাসানকে দেখেই তাকে বেধড়ক পেটাতে থাকেন শিবলী। কেউ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই কর্তব্যরত কনস্টেবলের রাইফেল কেড়ে নিয়ে হাসানকে গুলি করতে উদ্যত হন। শুধু তাই নয়, রেকর্ড মুছতে ভেঙে ফেলেন বাদীর মোবাইল ফোন। এ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশ শাখা, শৃঙ্খলা শাখা ও পুলিশ সদর দপ্তরের প্রজ্ঞাপন-আদেশ এবং তদন্ত প্রতিবেদন যুগান্তরের হাতে এসেছে।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রংপুর মহানগরীর নিউ সেনপাড়ার বাসিন্দা লিপি খান ভরসার পক্ষে থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন তার ম্যানেজার পলাশ হাসান। লিপি খান ভরসা একজন বিড়ি ব্যবসায়ী। তিনি হারাগাছ এলাকার শিল্পপতি জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি প্রয়াত করিম উদ্দিন ভরসার পুত্রবধূ। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় লিপি খান ভরসাকে আসামি করা হয় (যদিও অনেকেই বলছেন, জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে ওই মামলায় জড়ানো হয়)। মামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে তিনি যোগাযোগ করেন রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক ও স্বৈরাচারের দোসর হিসাবে পরিচিত অমিত বণিকের সঙ্গে। অমিত বণিক তাকে আশ্বাস দেন, পুলিশ কর্মকর্তা শিবলীর মাধ্যমে আসামির তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। বিনিময়ে ১০ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেন অমিত বণিক। পরে বনিবনা না হওয়ায় পলাশ হাসান মামলা করতে থানায় যান।
পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এসপি শিবলীর বিরুদ্ধে পলাশ হাসানকে মারধর, কনস্টেবলের রাইফেল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা এবং বাবা-ছেলেকে জোর করে থানায় নিয়ে মুচলেকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে তার অফিসে এক ব্যক্তি গেলে তাকে গালিগালাজ ও মারধরের হুমকির অভিযোগ আংশিক সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। তদন্তকালে ২১ জন পুলিশ সদস্যসহ ২৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। যেসব পুলিশ সদস্য সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা হলেন-আরপিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সাক্ষ্যকালে) নরেশ চাকমা, উপপুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, কোতোয়ালি থানার ওসি আতাউর রহমান, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুস শুকুর মিয়া, এসআই শাহীনুর রহমান, হাবীবুর রহমান, এএসআই শাহাদুল ইসলাম, ফজলুল হক, নূতন বাবু রায়, কনস্টেবল রাব্বি হোসেন, মৌসুমী আক্তার, নাঈম ইসলাম, বাসুদেব রায়, সংগীতা রানী, আব্দুল খালেক, শাহিনুর রহমান, নাজমুল ইসলাম, শাহ আলম, জিকারুল ইসলাম, সোহাগ রানা এবং রাশেদুজ্জামান রুমন চৌধুরী। অন্য সাক্ষীরা হলেন-ল্যান্স করপোরাল মাহবুব আহমেদ, নীলফামারী সৈয়দপুরের হাবিবুর রহমান পরশ, লাশমনিরহাট কালীগঞ্জের জোবায়ের হোসেন বন্ধন ও বায়োজিদ ইসলাম।
উপকমিশনার হাবিবুর রহমান ছিলেন শিবলী কায়সারের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, লিপি খান ভরসার কাছে চাঁদা দাবিসংক্রান্ত একটি কল রেকর্ডের ভিত্তিতে গত ১৩ মার্চ বিকালে একটি এজাহার নিয়ে থানায় আসেন পলাশ হাসান। এজাহারে ডিসি (ক্রাইম) শিবলী কায়সারের নাম থাকায় ওই নামটি বাদ দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। বাদী এতে সম্মত হলে তাকে (বাদী) নিয়ে ওসি এজাহার পুনরায় টাইপ করার জন্য কম্পিউটার রুমে বসেন। ইতোমধ্যে এজাহারে নিজের নাম থাকার কথা শুনে থানায় এসে উত্তেজিত হয়ে পড়েন শিবলী। তিনি বাদীকে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকেন। একপর্যায়ে সেন্ট্রি ডিউটিতে থাকা নারী কনস্টেবল মৌসুমী আক্তারের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে বাদীকে মারার জন্য উদ্যত হন। এ সময় ওসিসহ অন্য পুলিশ সদস্যরা শিবলীর কাছ থেকে অস্ত্রটি নিয়ে সেন্ট্রিকে ফেরত দেন। পরে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (কনফিডেন্সিয়াল) কামরুল আহসানের নাম ধরে থানা প্রাঙ্গণে জনসম্মুখে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন শিবলী কায়সার। এরই মধ্যে আমি (ডিসি হাবিবুর) দাপ্তরিক কাজে থানায় যাই। ওসির রুমে কথা বলার সময় আমার সামনেই শিবলী কায়সারের নির্দেশে তার দেহরক্ষী মো. নাঈম বাদী পলাশ হাসানের মোবাইল ফোন ফ্লোরে নিক্ষেপ করে ভেঙে ফেলে। পরে পলাশ হাসানের করা অভিযোগের ভিত্তিতে এ সংক্রান্ত একটি মামলা হয়। এ মামলায় ব্যবসায়ী অমিত বণিককে গ্রেফতার করা হয়। কারণ শিবলী কায়সারের পক্ষে অমিতই চাঁদা দাবি করেছিলেন লিপি খান ভরসার কাছে। অমিত বণিক এর আগে সাবেক ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য, সাবেক পুলিশ কমিশনার আব্দুল আলিম মাহমুদ, সাবেক কমিশনার মনিরুজ্জামান এবং সাবেক এসপি বিপ্লব কুমার সরকারসহ সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অবৈধ টাকা কামিয়েছেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের অর্থদাতা। তিনি একটি প্রতিবেশী দেশের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট বলেও জনশ্রুতি আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসপি শিবলী কায়সার বিসিএস পুলিশের ২৮তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। চাকরি জীবনে তিনি দুইবার লঘুদণ্ড পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাপরিপন্থি কার্যকলাপ এবং ঘুস গ্রহণের সুনির্দিষ্ট বেশ কয়েকটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
এসপি (সাময়িক বরখাস্ত) মোহাম্মদ শিবলী কায়সার তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেন, পলাশ হাসানকে মারধরের অভিযোগটি শতভাগ মিথ্যা। আমি নারী কনস্টেবল মৌসুমী আক্তারের রাইফেল কেড়ে নেওয়ারও কোনো চেষ্টা করিনি। এছাড়া আমার বিরুদ্ধে অন্যান্য যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলোরও সত্যতা নেই।