ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের বাকি মাত্র আড়াই মাস। ভোটের মাঠে এখন প্রচারণাসহ নানা কৌশল ঠিক করছে রাজনৈতিক দলগুলো। এরই অংশ হিসাবে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে বড় পরিকল্পনা সাজিয়েছে বিএনপি। পহেলা ডিসেম্বর থেকে ১৬ দিনব্যাপী মশাল প্রজ্বালন কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছে দলটি। এর উদ্দেশ্য নির্বাচনকে সামনে রেখে বার্তা দেওয়া-একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে তারা পথ চলতে চায়। এই কর্মসূচি চট্টগ্রাম থেকে শুরু হবে, ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে ঢাকায় বড় সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এতে মূল চমক থাকবে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের আহদ যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণ। মূলত এর মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটের প্রচারে নামছে বিএনপি। দলটির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
এই কর্মসূচি পরিকল্পনায় যুক্ত একাধিক বিএনপি নেতা যুগান্তরকে জানান, আধুনিক সময়ে অলিম্পিকে মশাল প্রজ্বালনের মতো প্রতীকী অনুষ্ঠান হয়। অনেকটা এ রকমভাবেই পহেলা ডিসেম্বর চট্টগ্রামের স্বাধীনতা পার্কে বড় সমাবেশের মধ্য দিয়ে মশাল প্রজ্বালনও বহন শুরু হবে। তা বিভাগীয় শহর ও বেশ কয়েকটি জেলায় ঘুরে ঢাকায় এসে শেষ হবে। পথে কয়েকটি পথসভা করার কথা রয়েছে। এই মশাল প্রজ্বালন শেষ হবে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশের মধ্য দিয়ে। বিজয়ের মাসে এই কর্মসূচির মধ্য দিয়েই ধানের শীষের পক্ষে ঢেউ ওঠাতে চান। কর্মসূচি সফল করতে দফায় দফায় বৈঠকও চলছে। নেতারা বলেন, বিএনপি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি দল। তাই যে ধর্মের যা পাওনা তা তারা তুলে ধরতে চায়। একই সঙ্গে বিএনপি আগামীতে কী করবে, চেতনা কী হবে-তাও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে জানাতে চায়।
জানতে চাইলে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, মশাল প্রজ্বালন চট্টগ্রাম থেকে শুরু হবে। ওখান থেকেই সব বিভাগেই মশাল বহন করা হবে। সবশেষ ঢাকা সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এটি সফল করতে বিএনপি প্রস্তুতি নিয়েছে। এতে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং জুলাই আহত যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা থাকবে-এভাবেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, এই কর্মসূচি সফল করতে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জুলাইয়ে আহত যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরাও থাকবেন বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, জুলাই যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা বেশি পরিচিত তারা থাকবেন। এর মধ্যে শহীদ মীর মুগ্ধের ছোট ভাই ও সদ্য বিএনপিতে যোগদানকারী মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধও রয়েছেন। এছাড়া গত ৮ নভেম্বর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে ভার্চুয়ালি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ঘোষণা দেন চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত পরিবারের সদস্যরা। যার মধ্যে ছিলেন শহীদ ওয়াসিমের বাবা শফি আলম, শহীদ মাহমুদুর রহমানের বোন (জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠকারী) সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী, শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বাবা মাহবুবুর রহমান, শহীদ ফয়সাল আহম্মেদ শান্তর বাবা মো. জাকির হোসেন এবং চব্বিশের জুলাই গণ-আন্দোলনে আহত মো. ফারহান জামিল। তারাও এই কর্মসূচিতে থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
সূত্রমতে, গত সোমবারও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার শহীদ পরিবারের সদস্যরা বিএনপিতে যোগ দেন। তারা হলেন-চব্বিশের জুলাইয়ে ঢাকায় মহাখালীতে পুলিশের গুলিতে নিহত ঘোষগাঁও ইউনিয়নের জরীপাপাড়ার শহীদ শাহজাহানের মা সাজেদা বেগম, ঢাকার বাড্ডায় পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ সোহেল মিয়ার বাবা আবদুল হাকিম, ঢাকার আজমপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ মাজেদুল ইসলামের বাবা আবদুল মান্নান, ভাই জালাল উদ্দিন এবং ঢাকার সাভারে পুলিশের গুলিতে শহীদ মওলানা সাদেকুর রহমানের ভাই হাফেজ মওলানা সাদ্দম হোসেন। এর আগে ৯ নভেম্বর হালুয়াঘাটের তিন শহীদ পরিবার-গাজীপুরের মাওনায় পুলিশের গুলিতে শহীদ কাওসার বিজয় ফরাজীর বাবা সায়েদুল ইসলাম ফরাজী, ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণে শহীদ সেখ সেলিমের বাবা কলিম উদ্দিন, মা সখিনা খাতুন, স্ত্রী আসমা খানম, ছেলে শাওন এবং গাজীপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ মনির হোসেন রাসেলের বাবা নিজাম উদ্দিন প্রাথমিক সদস্য ফরমে সই করে বিএনপিতে যোগ দেন। এর মধ্যে শহীদ মনির হোসেন রাসেলের লাশ গুম করা হয়। পায়নি পরিবার। দুটি পৃথক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তারা বিএনপিতে যোগ দেন। ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপিতে তাদের যোগদান গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার জন্য ঐতিহাসিক ও প্রেরণাদায়ক। বিএনপি গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে এবং বিএনপির পক্ষেই এ চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব। সেজন্যই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের সদস্যরা বিএনপির পক্ষে অবস্থান ঘোষণা করছেন।’
জানা গেছে, সারা দেশে আরও জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত যোদ্ধারা বিএনপিতে যোগদান করার কথা রয়েছে। তারাও বিএনপির মশাল প্রজ্বালন কর্মসূচিতে যোগ দেবেন।
‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ শীর্ষক ৬ দিনের কর্মসূচি : এদিকে ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ শীর্ষক ৬ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। যা ৭ ডিসেম্বর শুরু হবে, ১৩ ডিসেম্বর শেষ হবে। বৃহস্পতিবার জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা দেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে ২১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসাবে ভার্চুয়ালি থাকবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
৬ দিনের এই কর্মসূচি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল, কৃষক দল ও ওলামা দলের উদ্যোগে পৃথকভাবে এই কর্মসূচি পালন হবে। এই কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন দলের সিনিয়র নেতারা। প্রথম দিনে ৭ ডিসেম্বরের কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ৮ ডিসেম্বর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, ৯ ডিসেম্বর স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ১০ ডিসেম্বর স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ১১ ডিসেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ১৩ ডিসেম্বর কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
জানা গেছে, বাসযোগ্য, আধুনিক ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে সাতটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। এগুলো হচ্ছে-জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষা, শিক্ষা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি, স্বাস্থ্য, কৃষি, নারী, ক্রীড়া এবং ধর্ম। এসব বিষয়ে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী করবে; তা প্রতিশ্রুতি আকারে ভোটারের দ্বারে দ্বারে গিয়ে লিফলেটের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে। দলের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের সমন্বয়ে একাধিক টিম দ্রুতই মাঠে নামছে। এর অংশ হিসাবে ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ শীর্ষক কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের এ সম্পর্কিত নানা দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।