Image description
নাগরিক সুবিধা রয়েছে এক-তৃতীয়াংশ

একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ শতাংশ জায়গায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ শতাংশ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরাতন শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে শুধু ২৪ শতাংশ। নগরবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর অর্থ ঢাকায় রয়েছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ নাগরিক সুবিধা।

নগরবিদদের মতে, বিদ্যমান ঢাকার আয়তন বিবেচনায় অবকাঠামো তৈরি হয়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ জায়গায়। পরিকল্পিত শহরের প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১২০ জন বসবাস করে থাকেন। আর ঢাকায় বর্তমানে প্রতি একরে বসবাস করছেন গড়ে ২৫০ জন। ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় একরপ্রতি গড়ে ১৯২ জন, পুরান ঢাকায় একরপ্রতি গড়ে ৪০০ জন এবং পুরান ঢাকা বাদে ঢাকা দক্ষিণ সিটির অন্য অংশে বসবাস করছেন ২১২ জন। ধারণক্ষমতা বিবেচনায় ঢাকায় দ্বিগুণের বেশি মানুষ বসবাস করছেন। আর নাগরিক সেবার বিবেচনায় ঢাকা ৬ গুণ বেশি চাপ বহন করে চলেছে।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ৩ ভাগের ১ ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে দ্বিগুণ অর্থাৎ ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ৬ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। তবে এটা হলো পরিকল্পিত শহরের সঙ্গে তুলনা। ঢাকা যেহেতু অপরিকল্পিত শহর। সে হিসাবে এখানে একরপ্রতি ৭০ জন মানুষ বসবাস করতে পারেন। এভাবে চিন্তা করলে ঢাকায় চারগুণ মানুষ বসবাস করছেন।

ড. আদিল বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় চাইলেই আদর্শ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ইচ্ছা করলেই এখন সড়কের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এখনো কিছু উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সেটা হলো-বিদ্যমান সড়কগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো।

তিনি জানান, ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এজন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া রাজউকের ড্যাপের কিছু প্রস্তাব রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করে ঢাকার জনঘনত্ব কমানো এবং গণপরিসর বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ঢাকায় নতুন কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। যেমন-শিল্প, কলকারখানা এবং অন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে। এখন শুরু করলে ভালো পর্যায়ের পরিবর্তন দেখতে তাও ১৫ থেকে ২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এখনো সেদিকে কোনো দৃষ্টিপাত করছে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহা. মুসলেহ উদ্দীন হাসান যুগান্তরকে বলেন, একটি শহরে বেশি জনঘনত্ব হওয়া বা আয়তনে বড় হওয়া কোনো গৌরবের বিষয় নয়। কিন্তু দেশের রাজনীতিবিদদের বলতে শোনা যায়, মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি চট্টগ্রামকে, রাজশাহীকে মেগাসিটিতে রূপান্তরিত করবেন। এমন ধারণা থেকে রাজনীতিবিদদের বেরিয়ে আসতে হবে।

ড. হাসান বলেন, বড় শহর গৌরবের বিষয় নয়, গৌরবের বিষয় হলো শহরগুলোকে ম্যানেজ করতে পারা। ঢাকাকে হেলাফেলা করে যেখানে নিয়ে আসা হয়েছে, সরকার চাইলে লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। এজন্য কিছু উদ্যোগ নিয়ে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। আর নির্মাণ নয়, এখন বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বাসযোগ্যতা বাড়াতে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মাস্টারপ্ল্যান ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, দুই সিটির আয়তন ৩০৫ বর্গকিলোমিটার। লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করেন। যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করেন। যা বিশ্বে তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করেন। যেটা বিশ্বে দশম।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এই সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতোমধ্যে ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ ভাগ কংক্রিট-আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে। পরিকল্পনাবিদদের এ সংগঠনটি বলছে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ, নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে। আর কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হবে না। নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বোঝা যায়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। আর ২০২২ সালে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভিবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা বিশ্বের সপ্তম কম বসবাসযোগ্য শহর।

ঢাকাকে ঘিরে পরিকল্পনা হয়, বাস্তবায়ন হয় না : ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগর-পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেড্ডেসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগর পরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশ আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। এই নদীগুলোকে কেন্দ্র করে এক সময় মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো বহমান প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি নদীতে পড়ত। ফলে শহরে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখ।

এরপর পূর্ব পাকিস্তান সময়ে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরও একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। সে অনুযায়ী বেশকিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।

বাংলাদেশের পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এই মাস্টারপ্ল্যানের নাম ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)। এই পরিকল্পনা পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগ সঠিক ছিল। তবে ৩০ ভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। দেশের স্বার্থান্বেষী মহল ওই মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি করে। এসব বাধা মোকাবিলা করে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয় রাজউক। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়।

এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়। সিংহভাগ মানুষ এই ড্যাপকে সাধুবাদ জানালেও আবারও নানা বাধার মুখে পড়েছে পরিকল্পনাটি। গেজেটভুক্ত করার পর ইতোমধ্যে মাস্টারপ্ল্যানটি নানা চাপে দুবার সংশোধন করা হয়েছে।

জাতিসংঘ ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টস ২০২৫-এ বলা হয়েছে, জনঘনত্বের বিবেচনায় ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় মেগাসিটি। এই শহরে বসবাস করছে ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিদ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০-এ ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ জনঘনত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হবে। এর আগে ২০০০ সালে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ঢাকার অবস্থান সাত ধাপ পেছনে ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে জনসংখ্যার যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেটা কেন্দ্রীয় ঢাকায় নেই। যদি সমগ্র ঢাকা জেলা, গাজীপুর জেলা এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে তা সঠিক হবে। এই তিনটি জেলা এখন কার্যত একীভূত হয়ে গেছে। যদিও প্রশাসনিক নাম ভিন্ন।