টেকসই বাঁধের অভাবে উপকূলীয় এলাকার চরম জরাজীর্ণ ৬০০ কি.মি বেড়িবাঁধ এখন ১০ লাখ মানুষের মরণফাঁদ। আর অর্ধশত কি.মি. অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ বর্ষা মৌসুমের ঝড় ঝঞ্ঝা ও জোয়ারের পানিতে ভেঙে হাজার হাজার একর জমি প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় দিন যাপন করছে উপকূলবাসী। প্রতিবছর বাঁধ ভেঙে শত শত মৎস্য ঘের তলিয়ে হোয়াইট গোল্ড নামে খ্যাত চিংড়ি শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। আর আমন চাষীরা চাষাবাদ করতে না পারায় হাজার হাজার একর ফসলি জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। অসহায় উপকূলবাসীর দেখার যেন কেউ নেই। তারা নীরবে নিভৃতে গুমরে গুমরে শুধু চোখের পানি ফেলে।
খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলের ৬০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট প্লাবন মোকাবিলার সক্ষম নয়। প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। ভাসিয়ে নেয় হাজারো মানুষের বসতি, কেড়ে নেয় জীবন-জীবিকা।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ১৬ বছরে সুন্দরবনের উপকূলীয় জনপদে ১২টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এছাড়া বেশ কিছু নি¤œচাপও মানুষের জীবন যাত্রাকে চরমভাবে ব্যাহত করেছে। এসব ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের উপকূলীয় জনপদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এদিকে গত বুধবার উপকূলীয় এলাকায় মানববন্ধন পরবর্তী হাজার হাজার নারী পুরুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ‘সাহায্য নয়, টেকসই বাঁধ চাই’ এমন স্লোগানের আহাজারিতে সাতক্ষীরার দুর্গম এলাকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। আগামী বর্ষা মৌসুমে উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ বাঁধ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে মেরামতের দাবি জানান তারা।
সূত্রমতে, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি চিংড়ি চাষ। ওই জেলাগুলোর উপকূলীয় অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে চিংড়ি চাষের ওপর নির্ভরশীল। যখন লোকালয়ে সমুদ্রের লোনা পানি প্রবেশ করে তখন এসব অঞ্চলের চিংড়ি ঘেরগুলো পানিতে ভেসে যায়। ফলে বেশ মোটা অঙ্কের লোকসানে পড়তে হয় চিংড়ি চাষের সঙ্গে সম্পৃক্তদের। এ অঞ্চলের অর্থনীতি বেশ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পূর্বেই দরজায় কড়া নাড়তে থাকে নতুন কোনো ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হলেও এসব ঘের ব্যবসায়ীর জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না, যার ফলে এই ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হন এবং ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের দাবি, উপকূলীয় ওই তিন জেলার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ বেশকিছু জায়গায় সংস্কার করা হয়েছে। আরো কিছু এলাকা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টেকসই বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বাঁধের যেসব অংশ ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো পর্যবেক্ষণে রেখেছে পাউবো।
অপরদিকে আশাশুনির পল্লীতে মানববন্ধন থেকে জলবায়ুু পরিবর্তনজনিত কারণে অভিবাসিত পরিবারগুলোর তালিকা প্রণয়ন করে সরকারি সহায়তার আওতায় আনা, তাদের জন্য নিরাপদ আবাসন, কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি (ভিজিডি, ভিজিএফ, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যাক্ত ভাতা, বয়স্ক ভাতা ইত্যাদি) প্রদানে অগ্রাধিকার প্রদান করা, অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, নদীভাঙন রোধে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সুপেয় পানি নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়।
সূত্রমতে, জলবায়ুু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে এই অঞ্চলে প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ ঘটে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ুু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের কারণে অনেক পরিবার তাদের বসতভিটা হারিয়ে শহরের বিভিন্ন বস্তি ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে। এসকল স্থানান্তরিত জনগোষ্ঠীর জীবিকা, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
প্রতাপ নগরের বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, গত কয়েক বছর উপকূলীয় বেড়িবাঁধের প্রকল্পগুলো নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দীর্ঘসূত্রতা স্থানীয় লোকজনের জান-মালের নিরাপত্তা আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। সামনে বর্ষা ও ঝড়ের মৌসুম নতুন করে উৎকণ্ঠায় ফেলেছে উপকূলীয় বাসিন্দাদের। আমরা সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে টেকসই ও স্থায়ী বাঁধ চাই। উপকূলবাসীর আর কোনো চাওয়া পাওয়া নেই।
এ বিষয়ে কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি আমাদের বহুদিনের। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের জানালেও তারা শুধু আশ্বাস দেন। পরিকল্পিত ও স্থায়ী বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় প্রতি বছর ভাঙন দেখা দেয়। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের গাফিলতি দায়ী। আবার যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো শেষ করা হচ্ছে না।’