অর্থনৈতিক মন্দা, গ্যাস ও জ্বালানি সঙ্কট আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের শিল্প-কলকারখানা একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায় চলে গেছে। বিদেশিরা অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে বিনিয়োগ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতা গ্রহণের পর অর্থনীতির গতি ফেরানো এবং কলকারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরে দেশে ২৫৮টি রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য শিল্প কারখানাসহ মোট চার শতাধিক শিল্প কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১৫ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। এতে দেখা যায়, স্বাভাবিকভাবে চালাতে না পারায় মিল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত এক বছর থেকে প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার শ্রমিক বেকার হচ্ছে। এ হিসাবে প্রতিদিন ৪ হাজার একশ’রও বেশি কর্মজীবী শ্রমিক কাজ হারাচ্ছেন।
নতুন বিনিয়োগ ও নতুন কর্মসংস্থান না থাকায় বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। যেসব মিলকারখানা সাময়িক বন্ধের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে তার বেশির ভাগ কারখানাই আর চালু হচ্ছে না। কর্মহারা মানুষের আহাজারি বেড়েই চলেছে। কাজ না পেয়ে অনেক বেকার শ্রমিক অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। এতে সমাজে বাড়ছে অস্থিরতা।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলের লাগামহীন দুর্নীতি আর লুটপাটে দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। দেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল ড. ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি দ্রুত চাঙ্গা হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, কমবে বেকারত্ব। কিন্তু মানুষের সে আশা এখন দুরাশায় পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত এক বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে দেশে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। উল্টো বিভিন্ন স্থানে গার্মেন্টস ও কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। বাড়ছে বেকারত্ব। এতে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএ) জানায়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং জ্বালানি সংকটের কারণে বিগত এক বছরে দেশে ১৮৫টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কয়েক লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছেন। গত দুই মাসে রফতানি আয় কমেছে ৬ শতাংশ। বিজিবিএ টেকসই উৎপাদনের স্বার্থে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বিজিবিএর সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন পাভেল বলেন, ক্রমাগত কারখানা বন্ধ হওয়া এবং উৎপাদন হ্রাসের ফলে বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। রফতানি আদেশও আগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। তিনি জানান, গত দুই মাসে তৈরি পোশাক রফতানি ৫ থেকে ৬ শতাংশ কমেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, যা একত্রে শিল্প খাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তাই রাজনৈতিক নিশ্চয়তার জন্য দ্রুত নির্বাচিত সরকার আসা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, গত এক বছরে দেশে ২৫৮টি রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রফতানিমুখী শিল্পখাত নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। সরকার যদি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে পোশাক খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। বিশেষ করে নির্বাচিত সরকার দ্রুত না এলে দেশে শিল্প-কলকারখানার স্থবিরতা কাটবে না।
আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদনে দেশের শিল্প কলকারখানার সার্বিক চিত্র ফুটে উঠেছে। নিচে প্রতিবেদনগুলো তুলে ধরা হলো।
চট্টগ্রাম থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর আর্থিক মন্দায় চট্টগ্রামে একের পর এক কলকারখান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাতে বেকার হয়ে পড়ছে লাখো শ্রমিক। নতুন বিনিয়োগ নেই, বিদ্যমান কারখানাও নতুন ইউনিট চালু করতে পারছে না। তাতে বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। সাময়িক বন্ধের ঘোষণা দিলেও অনেক কারখানা আর চালু হচ্ছে না। কর্মহারা মানুষের আহাজারি বেড়েই চলেছে। গত এক বছরে কতটি কারখানা বন্ধ হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। তবে শিল্প পুলিশ, বিজিএমইএ ও ইপিজেড সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে গত এক বছরে দেড় শতাধিক ছোট-বড় কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ৭০টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ আর বাকি কারখানাগুলো অস্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। শিল্প পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, আর্থিক সংকট, ঋণের পরিমাণ বেশি থাকা, ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ না পাওয়া, এলসি জটিলতা এবং কাজের অর্ডারের অভাব এসব কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে।
রফতানি আদেশ না থাকায় অনেক তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ। কিছু কারখানা অর্ডার পাওয়ার পর চালু হচ্ছে, আবার বন্ধ রাখা হচ্ছে। গ্যাস সংকট ও নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা কমে যাওয়ায় ইস্পাত খাতের অনেক কারখানা বন্ধ। আবার কিছু কারখানা সীমিত আকারে চালু আছে। গত এক বছরে ১৩টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড, স্টিলমিল এবং প্যাকেজিং কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্প পুলিশের হিসাবে গত এক বছরে চট্টগ্রাম ইপিজেডসহ নগরীতে ৭০টি কারখানায় ৩১৫ বার শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। মালিকেরা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় এবং অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ হওয়ায় কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ কারখানার মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান, এস আলমের কারখানা এবং আলোচিত নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসে। অস্থিরতার কারণে কলকারখানার উৎপাদনের চাকা থমকে যায়। কাজ না থাকায় অনেক কারখানা বন্ধ। একটি নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত শিল্পখাতে এমন মন্দার অবসান হবে না বলেও মনে করেন তারা।
খুলনা থেকে আবু হেনা মুক্তি জানান, শ্রমিকদের কর্মচাঞ্চল্যে মুখরিত খুলনার শিল্পাঞ্চলে এখন দুর্ভিক্ষের ছোঁয়া। বন্ধ হয়ে যাওয়া জুটমিলগুলো পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। এতে করে হাজার হাজার শ্রমিক পরিবার চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দীর্ঘদিনের লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হয় খুলনা অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল। এতে চাকরি হারান প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক। প্লাটিনাম, ক্রিসেন্ট, দৌলতপুর, ইস্টার্ন, আলিমসহ ৯টি পাটকলে গত ৫ বছরে একাধিকবার ইজারার জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হলেও কার্যকর ফল আসেনি। স্টার এবং ক্রিসেন্ট জুট মিলেও একই দশা। একাধিকবার চুক্তি সম্পন্ন হলেও মিলগুলো চালু হয়নি। বিজেএমসি নীরব সাক্ষীগোপাল। ২০২২ ও ২০২৩ সালে খুলনার দৌলতপুর, ইস্টার্ন এবং যশোরের জেজেআই ও কার্পেটিং জুট মিল বেসরকারি মালিকানায় চালু হয়। তবে এর মধ্যে কেবল জেজেআই মিল কিছুটা ভালো করছে। এদিকে, বেকার হয়ে পড়া হাজার হাজার শ্রমিক বাধ্য হয়েছেন পেশা পরিবর্তন করতে। কেউ রিকশা চালাচ্ছেন, কেউ অটো-সিএনজি চালিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই গ্রামে ফিরে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
গাজীপুর থেকে মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, এ জেলার টঙ্গী, কোনাবাড়ী, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, গাজীপুর সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার শিল্প কারখানা রয়েছে। বিভিন্ন সংকটের কারণে গত এক বছরে এই জেলায় শতাধিক শিল্প কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এতে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে যেমন মানবেতর জীবনযাপন করছেন, আবার বেকার হওয়া শ্রমিকদের একটি অংশ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। যেসব সংকটের কারণে একের পর এক কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি সংকট, ব্যাংকিং খাতে অসহযোগিতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্ডার না থাকা, কার্যাদেশ বাতিল, শ্রমিক আন্দোলনসহ বৈশ্বিক নানা সংকট। গাজীপুর শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মালিকানা পরিবর্তন ব্যাংক ঋণ, রিসিডিউল না করা, কাজ না থাকা ইত্যাদি কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ শিল্প কারখানা আর্থিক সংকটের কারণেই বন্ধ হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে মো. হাফিজুর রহমান মিন্টু জানান, কয়েক বছর ধরে নানা কারণে নারায়ণগঞ্জের পোশাক খাতে অস্থিরতা চলছে। ৫ আগস্ট এর পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এটা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধাক্কা সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন শিল্প-কারখানার মালিকরা। এ অবস্থায় ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর থেকে এ পর্যন্ত শতাধিক পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক শ্রমিক। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, উৎপাদন অপ্রতুলতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ বিভিন্ন কারণে নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানাগুলোতে অস্থিরতা বেড়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের কারণে ব্যাহত হচ্ছে কারখানার উৎপাদন। ফলে সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে কারখানাগুলো। সবমিলিয়ে চাপ সামলাতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা।
জেলা শিল্পাঞ্চল পুলিশ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বতর্মানে নারায়ণগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে এক হাজার ৮৩৪টি পোশাক কারখানা রয়েছে। নিবন্ধনকৃত পোশাক কারখানার সংখ্যা এক হাজার ১০টি। বিভিন্ন কারণে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত এক বছরে ছোট-বড় শতাধিক পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জে যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, এসব কারখানার বেশিরভাগ শ্রমিক বেঁচে থাকার জন্য এখন অটোরিকশা চালাচ্ছেন। কিছু শ্রমিক গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার মোনুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার আসার কারণেই বিভিন্ন পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বিষয়টি তা নয়। কয়েকটি কারখানা আগে থেকেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছিল। বিগত সরকারের আমল থেকেই কারখানাগুলো দুর্বল অবস্থায় ছিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের পোশাক খাতের এই সমস্যা শুরু হয়েছে মহামারি করোনা সময়কাল থেকেই। ব্যাংকের সুদহার বেড়ে গেলে, অর্ডার কমতে থাকায় ও ব্যাংকঋণ বিতরণে বিমাতাসুলভ আচরণ প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করতে নাপারা কারখানাগুলো দুর্বল হতে থাকে। ৫ আগস্টের পর এই ধাক্কা সারাদেশে পড়লে অর্ডার আরো কমে যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সবমিলিয়ে কারখানাগুলোর আরো নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হলে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
সভার থেকে সেলিম আহমেদ জানান, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সাভার, আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলগুলোতে হঠাৎ করে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন লাখো লাখো শ্রমিক। বকেয়া বেতন, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। সম্প্রতি আশুলিয়ার নাসা গ্রুপ তাদের ১৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। এতে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, মালিকপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে কারখানা বন্ধ করে অন্য খাতে বিনিয়োগ করছে। এর আগে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বন্ধ হয়ে যায়। চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৪৩ হাজার শ্রমিক। অনেক শ্রমিক আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি পেলেও হাজার হাজার শ্রমিক এখনো বেকার। অনেকেই চাকরি না পেয়ে চা দোকানে কাজ করছে। কেউ টিকিট কাউন্টারে, কেউবা অটোরিকশা চালাচ্ছেন, অনেকে বাজারে সবজি বিক্রি করছেন। অনেকে আবার ছিনতাই, চুরিসহ নানান অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ভেতরে টেক্সটাইলসহ ১৫টি পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় ৪৩ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৪৩ হাজার শ্রমিকের পরিবারের প্রায় দুই লাখ সদস্য বিপাকে পড়েছে। পরিবারের কারো লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। শ্রমিকরা অন্য কারখানায় কাজ না পেয়ে দিনমজুরি করে জিবিকা নির্বাহ করছেন। আবার অনেকেই পরিবারের মুখে খাবার যোগাতে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধমুলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাই দ্রুত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ বন্ধ সকল কারখানা সচল করে পুরনো শ্রমিকদেরই চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানান এই শ্রমিক নেতা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশুলিয়ার ধনাইদ এলাকার জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস লিমিটেড, বাইপাইল এলাকার বার্ডস গ্রুপ, কাঠগড়া আমতলা এলাকার ছেইন এ্যাপারেলস লিমিটেড, পূর্ব নরসিংহপুর এলাকার ইথিক্যাল গার্মেন্টস লিমিটেড, নিশ্চিন্তপুর এলাকার এ জে সুপার গার্মেন্টস লিমিটেড, ফিরোজা গার্মেন্টস লিমিটেড, মাম গার্মেন্টস লিমিটেড, নাসা গ্রুপের নাসা এমব্রয়ডারি লিমিটেড, নাসা সুপার গার্মেন্টস লিমিটেড, নাসা সুপার ওয়াশ লিমিটেড, নাসা সুপার ওয়াশ ইউনিট-(২), ন্যাটিভ প্যাকেজিং লিমিটেড, নাসা বেসিক লিমিটেড, নাসা হাইটেক ওয়াস লিমিটেড, সাভার কর্ণপাড়া এলাকার এইচ আর টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, প্রতীক অ্যাপারেলস লিমিটেড, উলাইল এলাকার বেলকুচি নিটিং ্ ডায়িং এলটিডি, ছোট কালিয়াকৈর এলাকার গোল্ড স্টার গার্মেন্টসসহ অশংখ্য ছোট-মাঝারি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে ছোট পরিসরে কারখানা পুনরায় চালু করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শুধু অর্থনীতির জন্য নয়, কোটি মানুষের জীবিকার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকরা চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। তাদের জীবনে নেমে এসেছে হতাশা ও দুঃখ। বন্ধ কারখানার অনেক শ্রমিকই এখনও তাদের ন্যায্য পাওনা বুঝে পাননি। ফলে শ্রমিকদের জীবন প্রতিদিন আরো কঠিন হয়ে উঠছে।