Image description

রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দেড় হাজারের অধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এতে নিঃস্ব হয়ে গেছেন কয়েক হাজার মানুষ। শেষ আশ্রয়স্থলটুকু হারিয়ে তিনদিন ধরে রাত কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে। এখনো মেলেনি মাথা গোঁজার ঠাঁই। উল্টো পরিবারের সদস্যদের ক্ষুধা নিবারণে বের হতে হচ্ছে জীবিকার সন্ধানে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব বস্তিবাসী ত্রাণের গাড়ি দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন। গতকাল ক্ষুধার্ত এসব বস্তিবাসীর মধ্যে খাবার ও  ত্রাণ বিতরণ করেছেন কয়েকটি রাজনৈতিক দল, এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। যদিও তা ছিল চাহিদার তুলনায় যৎসামান্য। 

সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া ঘরের ছাই ও পোড়া টিনের স্তূপ পরিষ্কার করে কেউ কোনোরকম মাটিতে বিছানার চাদর বিছিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন। আবার কেউ আগুনে পোড়া ঘরের টিন, ধাতব বস্তু, ভাঙাড়ির কাছে বিক্রি করছেন, পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে। অনেকে ঘর পুনরায় নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছেন। এর মধ্যে খাবার নিয়ে কেউ এলেই তাদের পেছন ছুটছেন ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা। অনেকে খাবার না পেয়ে সাহায্যের আকুতি জানাচ্ছেন- সরকার ও বিত্তবানদের প্রতি।   

পুড়ে যাওয়া টিনের জড়ো করে এক জায়গায় রেখে কোনোমতে থাকার ব্যবস্থা করছিলেন লেগুনা ড্রাইভার রুবেল হোসেন। তিন মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে বস্তিতে থাকেন তিনি। গাড়ি চালিয়ে সংসার চালান। চোখের পানি ছেড়ে তিনি বলেন, সন্ধ্যায় নামাজ পড়বো তখন দেখি চারপাশের সবাই ছুটাছুটি করছে। অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোনোমতে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে  গেছি। চোখের সামনে তিলে তিলে গড়া সব আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, একদিকে গৃহহীন অন্যদিকে ক্ষুধা- মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ তিনদিন ধরে খোলা আকাশের নিচে আছি।

বাচ্চাগুলো ক্ষুধায় কান্না করছে, পকেটে একটা টাকাও নেই যে, তার মুখে কিছু খাবার দিবো। খাবারের জন্য বিভিন্ন সংগঠনের ত্রাণের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। খাবার নিয়ে কেউ এলেই সবাই হুড়োহুড়ি করতে থাকে অনেক সময় পাওয়া যায় না। সাহায্যের আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে পাশেই বনানী গুলশানে দেশের সব বড়লোকদের বসবাস। উনারা যদি আমাদের বিপদে একটু এগিয়ে আসেন তাহলে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। কেউ যদি নতুন ঘর বানানোর জন্য কিছু সাহায্য করে তাহলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে একটু ছাউনির নিচে বসবাস করতে পারতাম। 

একটু দূরে সরু গলির পাশে স্ত্রীর সঙ্গে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করছিলেন কামাল হোসেন। অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান তিনি। অগ্নিকাণ্ডের সময় তেজগাঁওয়ে ছিলেন। খবর শুনে এসে দেখেন পুরো বস্তি আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ পাচ্ছিলেন না তিনি। আধা ঘণ্টা পর তার স্ত্রী-সন্তানকে খুঁজে পান। কামাল বলেন, দেড় বছরের বাচ্চা ক্ষুধার যন্ত্রণায় কান্না করছে। সে তো অবুঝ কিছু বুঝে না। একদিকে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছি, অন্যদিকে খাবার নেই। তিনদিন ধরে জ্বরে রিকশা চালাতে পারিনি। জমানো স্বর্ণ, টাকা পয়সা যা ছিল সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যে রাতে আগুন লাগছে ঐ রাত সড়কে কাটিয়েছি। গতকাল পুড়ে যাওয়া টিন পরিষ্কার করে কোনোরকম খোলা জায়গায় বিছানা করে থেকেছি। রাতের বেলায় বাচ্চাটা শীতে প্রচণ্ড কষ্ট পায়। আমরা বড় মানুষ আমরা না হয় একটু কষ্ট করে থাকতে পারি। একদিকে শীত অন্যদিকে বাচ্চাটা ক্ষুধায় কান্না করে। কি করুম বুঝতে পারছি না। 

পুড়ে যাওয়া টিনের এক কোণে ত্রিপল দিয়ে কোনোরকম থাকার ব্যবস্থা করে ত্রাণের খাবার তাদের বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছিলেন আশরাফুল ও সোনিয়া দম্পতি। অগ্নিকাণ্ডের সময় পাশের একটি ভবনে রাজমিস্ত্রির কাজ করছিলেন আশরাফুল। তিনি বলেন, আগুন লাগার সংবাদ শুনে দ্রুত দৌড়ে এসে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে কোনোরকমে বের হয়ে আসি। আর আমার স্ত্রী ঘর থেকে শুধু টেলিভিশনটাই নিয়ে আসতে পেরেছিল। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভুক্তভোগী অনেকেই খাবার পাচ্ছে না। আর টাকার সাহায্য তো দূরের কথা। গতকাল জ্বর উঠেছিল এখানে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ওষুধ দেয়া হচ্ছে ওখান থেকে নিয়ে আসছি ওষুধ। আপনারা একটু সরকারকে বলেন আমাদেরকে যেন একটু সাহায্য দেয়। আমাদের কেউ নেই। 
ধ্বংস্তূপ আর লোহা-লক্কড় পেরিয়ে খাবার নিয়ে যাচ্ছিলেন আকিজ মনোয়ারা ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকরা। তাদের পেছন থেকে বেলাল হোসেন এসে বলছিলেন, আপনারা সবাই শুধু অন্যদিকে দেন। এদিকে ভিতরে অনেক পরিবার খাবারই পায়নি। বেলাল বলেন, সবাই ঠিকমতো ত্রাণ পাচ্ছে না। যারা খাবার দিচ্ছেন তাদের উচিত এক জায়গায় না দিয়ে যাদের ঘর পুড়ে গেছে প্রত্যেক ঘরে গিয়ে ত্রাণ দেয়া। তিনি আরও বলেন, আজকে তিনদিন ধরে খোলা আকাশের নিচে আছি। আগুনে তিল তিল করে গড়ে তোলা সকল আসবাবপত্র পুড়ে গিয়েছে। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে খাট টিভি কিনেছিলাম। প্রতি মাসে কিস্তি দিতে হয় কী করে কিস্তি দিব কিছুই বুঝতে পারছি না। জমানো সব স্বর্ণও পুড়ে  গেছে। এক কোণে কিছু ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করে কোনোরকম ভাবে মাটিতে বিছানার ব্যবস্থা করেছি। মেয়েরা খুব কষ্ট পাচ্ছে। কী করবো কিছু বুঝতে পারছি না। অন্য কোথাও যাওয়ার স্থান নেই। তাই এখানে থেকেছি খোলা আকাশের নিছে। খাবার সবাই এসে দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এভাবে আর কতদিনই বা দিবে। সরকারের পক্ষ থেকে বা কেউ যদি কিছু টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতো তাহলে খুব উপকৃত হতাম। 

এদিকে যে ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত সেই ঘরের মালিক হোসনে আরাকে পাওয়া যাচ্ছে না তিনদিন ধরে। তার বড় মেয়ে তাকে খুঁজে না পেয়ে দিগ্বিদিক ছুটছেন তার মেয়ে রোকেয়া। তিনি বলেন, বাসার গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। আমার মা ওই সময় সকল ভাড়াটিয়াদেরকে নামিয়ে নিরাপদ স্থানে রেখেছিলেন। ভাড়াটিয়াদের শিশু সন্তানদেরকে নামিয়েছেন। প্রতিটি ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার থাকায় আগুনের মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, আজকে তিনদিন ধরে আমার মা’কে খুঁজে পাচ্ছি না। থানায়ও অভিযোগ দিয়েছি। কেউ তো ইচ্ছা করে আগুন দেয় না। আমাদের পুরো ঘর পুড়ে ছাই হয়ে  গেছে। দয়া করে আমার মা’কে দেখলে আমাদের জানাবেন।