Image description

সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো যত টাকা ঋণ দিয়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশের বেশিই এখন খেলাপি।  আর মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৬ শতাংশ এখন খেলাপি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত এক বছরে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। খেলাপি ঋণের উচ্চহার অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত আগে যে অসংখ্য ঋণ নিয়মিত হিসেবে দেখানো হতো বা গোপন রাখা হয়েছিল, সংস্কারের ফলে বর্তমানে সেগুলো এখন প্রকাশ পাচ্ছে। এ কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হঠাৎ বেশি দেখাচ্ছে। এটি নতুন ঋণ বিতরণ ও খেলাপির কারণে নয় বরং আগের গোপন ঋণ শ্রেণিকরণের কারণেই। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সবকিছু স্পষ্ট করছে, প্রকৃত চিত্র সামনে আনছে, এটাই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ। 

ব্যাংকাররা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কম করে দেখানোর যে প্রবণতা ছিল, তা এখন হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠিত হওয়ার সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফসিল ব্যবস্থা চালু হয়। এরপর থেকে নানা শিথিলতায় খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছিল। এক্ষেত্রে কখনও ঋণ পরিশোধ না করেই নিয়মিত রাখা, নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে পুনঃতফসিল কিংবা ভুয়া ঋণ নিয়ে দায় সমন্বয়ের সুযোগ দেয়া হতো। 

বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের হিসাব করে থাকে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে। গত জুন মাসে খেলাপি ঋণ ছিল ৬ লাখ ৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৩৬ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে অনিয়ম, জালিয়াতি, প্রতারণা ও দুর্নীতি এত বেশি মাত্রায় হয়েছে যে খেলাপি ঋণের এ উচ্চ হার সেই চিত্রেরই প্রমাণ দিচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকাররা বলছেন, এ কারণেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোকে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণের আসল চিত্র সামনে আনতে হচ্ছে। আদায় না করে এখন আর নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে বিদেশি অডিট ফার্ম দিয়ে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণের তথ্য যাচাই হয়েছে। গত এপ্রিল থেকে ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তিন মাস পর খেলাপি করা হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। ২০১৯ সালের আগে ওই সীমা ছিল ছয় মাস। বিশেষ সুবিধা দিয়ে অনেকের ক্ষেত্রে এক বছর সময়ও দেয়া হতো। 
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬.৪৪ লাখ কোটি টাকা। তবে পারভেজ মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে, যার জন্য তিনি সরকারি নীতিকেই দায়ী করছেন। আগে ঋণ পুনঃতফসিল করতে ঋণগ্রহীতাদের ৬ মাস সময় দেয়া হতো। কিন্তু আগামী মার্চ থেকে এই সময় কমিয়ে ৩ মাস করা হচ্ছে। বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি পারভেজ মনে করেন, এই নীতি খেলাপি ঋণ আরও বাড়িয়ে দেবে।

অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, কঠিন পদক্ষেপ না নিলে উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে দেশের অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি হবে। এতে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনা সংকুচিত হতে পারে। কীভাবে এই খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা করা হবে, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন তিনি। 
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগে যে অসংখ্য ঋণ নিয়মিত হিসেবে দেখানো হতো বা গোপন রাখা হয়েছিল, সংস্কারের ফলে সেগুলো এখন প্রকাশ পাচ্ছে। এ কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হঠাৎ বেশি দেখাচ্ছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে (৩০শে সেপ্টেম্বর) দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের স্থিতি ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে, যা বিতরণকৃত ঋণের ৩৫.৭৩ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষেও ব্যাংক খাতে খেলাপি হওয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ওই সময় বিতরণকৃত ঋণের ২০.২ শতাংশ খেলাপি ছিল। সে হিসাবে মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোয় ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। গত এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে তা নজিরবিহীন। আর খেলাপি ঋণের যে হার দাঁড়িয়েছে, সেটি গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।