দেশে মব সহিংসতা ও গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে এ ধরনের ঘটনায় ১৪০ জন নিহত হয়েছে, যা অন্যান্য বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক যুগে এ ধরনের ঘটনায় সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গত ১০ মাসে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির অন্তত ২৫৬টি ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০২৩ সালে এ ধরনের ঘটনায় ৫১ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৪ সালে এমন ঘটনায় মৃত্যু ১২৮ জনে পৌঁছায়।
আসক ও এইচআরএসএসের তথ্য মতে, গত ১২ বছর ১০ মাসে বাংলাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে এক হাজার ১৩ জন। এক যুগের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ঢাকা বিভাগে।
আসকের তথ্য মতে, দেশে গত ১২ বছরে গণপিটুনিতে কমপক্ষে ৮৭৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর কোনোটিতে ছেলেধরা বা ডাকাত সন্দেহে, আবার কোনো কোনো ঘটনায় চোর সন্দেহেও পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে।
এইচআরএসএস বলছে, মব সহিংসতা ও গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি জানুয়ারি-অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক এইচআরএসএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ মাসে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ২৩১ জন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীরা এই সহিংসতার শিকার হয়েছে।
এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দিন দিন মব ভায়োলেন্স বেড়ে যাচ্ছে। অক্টোবর পর্যন্ত আমরা প্রতিবেদন দিয়েছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, নভেম্বরে মব ও গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে।’ তিনি বলেন, মব ভায়োলেন্স দূর করতে সরকারের সদিচ্ছাটা জরুরি। এ ছাড়া কেউ হত্যাকাণ্ড ঘটালে তার কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, সেটির যথাযথ প্রয়োগ করলে মব সন্ত্রাস কমে আসবে। রাজনৈতিক দলেরও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
বিশ্লেষকরা এর জন্য সরকারের দৃঢ় অবস্থানের অভাব, রাজনৈতিক দলগুলোর ঔদাসীন্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকর ভূমিকার অভাবকে দায়ী করছেন। এখনই মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে দিন দিন তা আরো বাড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব মব ও গণপিটুনির ক্ষেত্রে কখনো বিগত সরকারের কর্মী-সমর্থক সন্দেহে, কখনো বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে মব সন্ত্রাস করা হচ্ছে। আবার কখনো চুরির সন্দেহে এসব গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, অনভিপ্রেত ও আকস্মিক সহিংসতা ব্যক্তির জন্য এক বিপর্যয়কর অভিজ্ঞতা। এ রকম অভিজ্ঞতা মানুষের চিন্তাজগেক প্রবলভাবে নাড়া দেয়, মনে চাপ সৃষ্টি করে। অনেকের ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া তীব্র হয়ে দৈনন্দিন জীবনযাপনকে ব্যাহত করে এবং ব্যক্তির শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য, সামগ্রিক সুস্থতা ও কল্যাণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষত কোমলমতি শিশুদের মনে এ ধরনের ঘটনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি।
মানবাধিকারকর্মীদের মতে, গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে ভয় পাচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা কালক্ষেপণ করছে, যথাযথভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই অনেকেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে এবং মানুষের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, মব সন্ত্রাস আগের চেয়ে কমেছে। সেটা যাতে আরো কমানো যায়, সে চেষ্টা করছে পুলিশ।’
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে গণপিটুনির সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে গণপিটুনির হার ছিল ভয়াবহ। আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে নিহত হয় ১২৮ জন। নির্বাচনের বছর মারা যায় ১২৭ জন। নির্বাচনের পরের বছর ২০১৫ সালে ১৩৫ জন নিহত হয়। ২০১৬ সাল থেকে গণপিটুনির সংখ্যা কমতে শুরু করে। সে বছর হত্যা কমে ৫১ জনে নেমে আসে। ২০১৭ সালে ছিল ৫০ জন। নির্বাচনের বছর ২০১৮ সালে তা ৩৯ জনে নেমে আসে। পরের বছর ২০১৯ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে ৬৫ জনে পৌঁছায়। ২০২০ সালে ছিল ৩৫ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন ও ২০২২ সালে ৩৬ জন হত্যার শিকার হয়। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০২৩ সালে হত্যার সংখ্যা আগের দুই বছরের তুলনায় বেড়ে ৫১ জনে পৌঁছায়। ২০২৪ সালে শতক পেরিয়ে ১২৮ জন হত্যার শিকার হয়।
সপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন দেশে কোনো জনপ্রতিনিধি নেই, পুলিশের ওপর সরকারেরও নিয়ন্ত্রণ আছে কি না সন্দেহ। এই সুযোগে স্বার্থান্বেষী মহল মব সন্ত্রাস করে যাচ্ছে। সরকারপ্রধান যদি কোনো গোষ্ঠীর সরকার বলে প্রচার করেন, তাহলে সেই গোষ্ঠীও মব সন্ত্রাস করতে ভয় পায় না।’ এই আইনজীবীর মতে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ সমস্যা কমবে না। বরং সরকার উদ্যোগী না হলে সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে গরু চুরি করে পালানোর সময় গণপিটুনিতে শামিম মিয়া নামের এক যুবক নিহত হন। আহত হন আরো সাতজন। নিহত শামিম (৪২) গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের ফুলারপাড় গ্রামের মুন্নু মিয়ার ছেলে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামের এক যুবক গণপিটুনিতে নিহত হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে গণপিটুনির ঘটনা ব্যাপক আলোচিত ছিল। একই বছর ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ গণপিটুনিতে নিহত হন। ২০১৯ সালের ২০ জুলাই সকালে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তাসলিমা বেগম রেণু নামের এক নারীকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা বেশ আলোচিত হলেও এখন পর্যন্ত ওই হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়নি।