Image description

টুঙ্গীপাড়া এখন দিনের আলোতেই এক ভুতুড়ে নগরী। সন্ধ্যা নামতেই নেমে আসে রাজ্যের নীরবতা। অথচ এক সময় দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই টুঙ্গীপাড়া থাকতো লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধুর মাজারকে কেন্দ্র করে সারা দেশের মানুষ ছুটে যেতেন সেখানে। কিন্তু এখন অন্ধকার নগরী।

অন্যদিকে ঘরে ঘরে চাপা ক্ষোভ আর দীর্ঘশ্বাস। একনাগাড়ে প্রায় ষোল বছর টুঙ্গীপাড়ার সন্তান শেখ হাসিনা ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। টুঙ্গীপাড়াবাসীর আশা ছিল শেখ হাসিনার বদৌলতে বদলে যাবে তাদের ভাগ্য। এখানে হবে শিল্প-প্রতিষ্ঠান। হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। কিন্তু দিন শেষে তারা যেই চাষা সেই চাষাই রয়ে গেছেন। আর উন্নয়ন বলতে শুধু নির্দিষ্ট স্থানে হয়েছে লোক দেখানো কাজ। আর এ জন্যই টুঙ্গীপাড়াবাসীর মনে ক্ষোভ। তারা এখনো ঘুম থেকে উঠে জাল নিয়ে যান বিলে। মাছ ধরে তা বিক্রি করে সংসার চালান। কেউবা কৃষিজমিতে কামলা দিতে ছুটেন। ইদানীং কেউ কেউ মাছের ঘের দিয়েছেন। তা থেকে কিছু আয় করছেন। আবার কেউ মুরগির ফার্ম দিয়ে উপার্জনের চেষ্টা করছেন।

এ ছাড়া বেতের হস্তশিল্প একটি শ্রেণি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তারা বংশগতভাবে বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্প তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান হওয়ায় এখানে পর্যটনকেন্দ্রিক একটি সেবা খাতও গড়ে উঠেছে। যেখানে হোটেল, রেস্তরাঁ এবং অন্যান্য পর্যটন-সম্পর্কিত পেশা দেখা গেছে। 

শনিবার সকালে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাশের বাড়ির তৌহিদ হাসানের সঙ্গে কথা হয়। টুঙ্গীপাড়া ৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা তৌহিদকে এলাকার উন্নয়নের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি ক্ষেপে উঠেন। বলেন, উন্নয়ন বলতে এই রাস্তাটিই। আর বঙ্গবন্ধুর মাজারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি। আরও রয়েছে শেখ হাসিনার একটি বাড়ি। তৌহিদ বলেন, শেখ হাসিনা এই রাস্তা দিয়ে মাজারে আসেন বলেই রাস্তাটি হয়েছে। না হলে রাস্তাটিও হতো না। 

ওদিকে শেখ রাসেল শিশুপার্ক করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মাজারের পেছনের দিকে। এই মাজারকে ঘিরে গত ষোলটি বছর ছিল এই এলাকা জমজমাট। পর্যটন করপোরেশনের নিজস্ব কার্যালয় সহ বঙ্গবন্ধুর মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল হরেক রকমের হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট আর সরকারের নানা সরকারি দপ্তরের অফিস। কিন্তু গত বছর ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিশেষ করে সেনাসদস্যদের ব্যারাক, পুলিশি নিরাপত্তা চৌকি, গোয়েন্দা সংস্থার নিরাপত্তা সব কিছুই এখন উঠে গেছে। ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে টুঙ্গীপাড়ায়। পিকনিক স্পট আর বিনোদন কেন্দ্রগুলো ধুঁকছে দর্শকের অভাবে। একসময় লোকে লোকারণ্য টুঙ্গীপাড়ায় বিরাজ করছে সুনশান নীরবতা। কালেভদ্রে ২/১ জন দর্শনার্থী আসলেও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে পুলিশ কাউকে মাজার কমপ্লেক্সে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না।

টুঙ্গীপাড়ায় প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যকোনো দল তাদের কার্যক্রম চালাতে পারতো না। অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল তাদের কার্যক্রমের উপর। তাই সে সময় বিএনপি ও জামায়াতের কোনো রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি না হলেও জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে এখানে বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছেন। অন্যদিকে সুনশান নীরবতা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। 

টুঙ্গীপাড়া এখন কেমন আছে? এ প্রশ্নে গিমাডাঙ্গা গ্রামের প্রমোদ দাস বলেন, এখন বলতে গেলে অনেকটা চাপ মুক্ত আছি। আওয়ামী লীগ আর তার অঙ্গসংগঠনের লোকজনের কারণে কথা বলাই ছিল মুশকিল। যেকোনো কাজে বাধা দিতো তারা। এখন স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছি। আগে নিজের জমিতে কাজ করতে গেলেও তাদের কথার বাইরে যেতে পারতাম না। হিন্দু সম্প্রদায়ের কতো লোকের জমি যে দখল করে নিয়েছে ওরা- এর ইয়ত্তা নেই। জমির জন্য অনেকে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ওদের মনে কোনো মায়া হয়নি। একই গ্রামের আজাদ হোসেন বলেন, আমাদের গর্ব ছিল এটাই- দেশের প্রধানমন্ত্রী আমার এলাকার মেয়ে। কিন্তু এলাকার মেয়ে হয়ে আমাদের উন্নয়নের দিকে তিনি ফিরেও তাকাননি। একটি শিল্প- কারখানাও করেননি। যেখানে এ এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। শ্রীরামকান্দি গ্রামের ফজলে শেখ বলেন, গত এক বছর ধরে টুঙ্গীপাড়ার জৌলুস মিইয়ে গেছে। সন্ধ্যায় আর বাতি জ্বলে না টুঙ্গীপাড়ায়। মানুষের আনাগোনা একেবারেই নেই। আওয়ামী লীগের লোকজন পালিয়ে গেছে। আমরা যারা আছি ভয়ে ভয়ে। এদিকে গেলেও যন্ত্রণা আবার ওদিকে গেলেও যন্ত্রণা। পাটগাতী গ্রামের রাহাত মিয়া বলেন, টুঙ্গীপাড়া আসলে এক অভিশপ্ত নাম। এখানে জন্ম নেয়াটাই যেন অন্যায়। গত ষোল বছর নিজের এলাকার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেও আমাদের জন্য একটুও ভাবেন নি। তিনি ভেবেছেন তার বাড়িকে কীভাবে সুন্দর করা যায়। আমরা যেমনটি ছিলাম আগে- এখনো তেমনই রয়ে গেছি। একই গ্রামের সামাদ হোসেন বলেন- নদী, খাল আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। আল্লাহর দেয়া এ নেয়ামতই আমাদের উপার্জনের মাধ্যম। অন্যথায় আমাদের অন্য এলাকায় গিয়ে ভিক্ষা করে খেতে হতো। আসলে টুঙ্গীপাড়াবাসী ভালো নেই। শতকরা নব্বই ভাগ মানুষই অবহেলিত। এক রাস্তার শহর টুঙ্গীপাড়া। এই রাস্তা থেকে বাঁশের সাঁকো দিয়ে বাড়ি যেতে হয়। আর একটু দূরে যারা- তাদের ভরসা নৌকা।  

টুঙ্গীপাড়ায় হিন্দু জনসংখ্যা তুলনামূলক বেশি। টুঙ্গীপাড়া উপজেলা মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত দেশ-বিদেশে। টুঙ্গীপাড়া একটি পৌরসভা ও পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত একটি উপজেলা। গোপালগঞ্জ জেলার দক্ষিণে অবস্থিত এই টুঙ্গীপাড়া, যার উত্তরে গোপালগঞ্জ সদর ও কোটালীপাড়া উপজেলা এবং দক্ষিণে ও পশ্চিমে মধুমতি নদী। ৪৯.১৩ বর্গমাইল এলাকার টুঙ্গীপাড়া নদী আর খাল-বিলে ঘেরা। কথিত রয়েছে পারস্য এলাকা থেকে আসা কিছু মুসলিম সাধক এই এলাকার প্লাবিত অঞ্চলে টং বেঁধে বসবাস করতে থাকেন। কালক্রমে ওই টং থেকেই নাম হয় টুঙ্গীপাড়া। টুঙ্গীপাড়া উপজেলায় মধুমতি নদী ছাড়াও আরও কয়েকটি নদী রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- ঘাঘর নদী, দাড়ির গাঙ নদী, কাটাখাল নদী এবং শালদহ নদী। টুঙ্গীপাড়া ৪নং ওয়ার্ডের ইমামুল হক বলেন, এই নদীগুলোই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে মনে কোনো কষ্ট নেই। আমরা গরিব, আমাদের এভাবেই দিন কাটাতে হবে- আশা করতে পারি। কিন্তু আশাহত হলে বলার জায়গাও নেই। শেখ হাসিনা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক। আমরা যেমনই থাকি এ দোয়া সব সময় করি। এলাকার মেয়ে হিসেবে তার প্রতি ভালোবাসা যেমন আছে, ক্ষোভও তেমন রয়েছে।