Image description

দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পনে মানুষের শারীরিক ক্ষতি হলে প্রথমে যাবেন হাসপাতালে। কিন্তু রাজধানীর সরকারি অনেক হাসপাতালই অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। এর বাইরে ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবিলার মতো প্রস্তুতিও নেই হাসপাতালগুলোর।

দেশের সরকারি ও বেসরকারি বড় সব হাসপাতাল ঢাকায় অবস্থিত। এসব হাসপাতালের ওপর নির্ভর করছে সারা দেশের রোগীদের বড় অংশ। রাজধানীর হাসপাতালগুলোর মধ্যে সরকারি বড় হাসপাতালগুলোর অনেক ভবন পুরনো এবং জরাজীর্ণ। বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল ও মিটফোর্ড হাসপাতাল ভবন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের জরুরি চিকিৎসার প্রাণকেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব সময় শয্যার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ রোগী চিকিৎসা নেন। এই হাসপাতালের মূল ভবনে বেশি রোগী চিকিৎসা নেন। শতবর্ষী এই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের একটি। 

ফায়ার সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালের তালিকায় ২৪৮টি হাসপাতালের নাম রয়েছে। এ ছাড়া অতি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে ১৭৪টি হাসপাতাল। এসব হাসপাতালের মধ্যে সরকারি হাসপাতালও রয়েছে।

২০১৭ সালে ঢাকাকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে সব ধরনের স্থাপনা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয় ফায়ার সার্ভিস। এর অংশ হিসেবে ঢাকার ৪৩৩টি হাসপাতালও পরিদর্শন করা হয়। প্রতিবেদনে ২৪৮টি হাসপাতালকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ১৭৪টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী অগ্নিঝুঁকিতে থাকা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কথা বলা হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহু বছরের পুরাতন মূল ভবনটি ভূমিকম্পের প্রচণ্ড ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ভবনের বয়স ১২০ বছর। গণপূর্ত বিভাগ এই ভবনটি অনেক আগেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এই হাসপাতালের মূল ভবনটি পরিদর্শন করেছেন এবং যথারীতি এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গত শুক্রবারের ভূমিকম্পের ঘটনায় হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা এবং সেইসঙ্গে চিকিৎসাধীন রোগীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। ২ হাজার ৬০০ বেডের সর্ববৃহৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসাধীন রোগী থাকেন চার সহস্রাধিক। এই মূল ভবনটি ১৯০৪ সালে আসাম গভর্নরের সচিবালয় ছিল। বৃটিশরা ১৯৪৬ সালে ১০ই জুলাই এটিকে ২০০ বেডের হাসপাতাল করেছিল।  ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরাতন মূল ভবনটির বেশির ভাগ অংশই ইট সুরকি দিয়ে তৈরি। 

রাজধানীর আরেক পুরনো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড) এর দুটি ভবন অনেক আগেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ এই দুই ভবনে এখনো কার্যক্রম চলছে। গত শুক্রবারের ভূমিকম্পে এই হাসপাতালে কর্মরতদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।  

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুর্যোগ যেকোনো সময়েই হতে পারে। তার জন্য আমাদের হাসপাতালের প্রস্তুতি থাকা জরুরি। হাসপাতালে দুর্যোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। একইসঙ্গে হাসপাতালকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা জরুরিও। যেকোনো দুর্যোগে হাসপাতাল প্রশাসন যেন প্রস্তুত থাকে, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালের নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা থাকতে হবে বলে জানান তারা।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভূমিকম্পন বা দুর্যোগের ধরন অনুযায়ী হাসপাতালে রোগী আসবে। বন্যা হলে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হবে। হাসপাতালগুলোকে দুর্যোগের ধরন অনুযায়ী প্রস্তুত থাকতে হবে। দুর্যোগের সময় নারী ও শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। এ সময় তাদের দিকে বিশেষ নজর দেয়া উচিত। বেশির ভাগ হাসপাতালই দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত নয়। আগুন ও ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের হাসপাতালগুলো একেবারেই প্রস্তুত নয়। যারা হাসপাতালে আসেন, তারা এমনিতেই কোনো না কোনো সমস্যার শিকার হয়ে আসেন। এর ওপর যদি আরেকটি দুর্যোগের মধ্যে পড়ে তা হবে খুবই বেদনাদায়ক। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারি হাসপাতালে কিছুটা হলেও জায়গা আছে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো খুবই অল্প জায়গায় গড়ে উঠছে। এগুলো হাসপাতালের উপযোগী নয়। আমাদের নিয়মিত ‘মক ড্রিল’ (দুর্যোগ মহড়া) করা উচিত। এমন কিছু হাসপাতাল আছে, যেগুলো ভেঙে নতুন হাসপাতাল বানাতে হবে। এগুলো মেরামত করে কোনো লাভ হবে না; বিশেষ করে ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। হাসপাতালগুলোর বছরে অন্তত একটি মক ড্রিল করা উচিত। হাসপাতালে যথেষ্ট জায়গা থাকতে হবে। 

এ প্রসঙ্গে দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্বদ্যিালয়ের (সাবেক বিএসএমএমইউ)-এর প্রাক্তন ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, দেশে বড় ধরনে ভূমিকম্পনের আশঙ্কা দেখছি। তাই আমাদের হাসপাতালগুলোকে এখনই প্রস্তুত করতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভবন অনেক পুরনো। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও পুরান। এদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। এজন্য সরকারকে পরিকল্পনা হাতে নেয়ার পরামর্শ দেন এই দেশবরণ্য চিকিৎসক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা বড় ভূমিকম্পনের পর কি ধরনের রোগীরা হাসপাতালে আসবে সে সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। তাই বেশি বেশি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কয়েকদিন পরপর মহড়ামূলক প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। সরকারকে টিম করে কাজ করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে টিম তৈরি করতে হবে। সরকারের কেন্দ্রীয় টিম থাকতে হবে। এধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোকেও তাদের স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। 

দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পনে ক্ষয়ক্ষতি হলে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত কিনা। জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্যবিদ, বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. আবু জামিল ফয়সাল মানবজমিনকে বলেন, হাসপাতালগুলোর একদমই প্রস্তুতি নেই। এই সম্পর্কে কোনো জ্ঞানও নেই হাসপাতালগুলোর। বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পন হলে বা দুর্যোগ মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোকে খুব দ্রুততার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। ভূমিকম্পনের পর নানা ধরনের রোগীরা যখন হাসপাতালে আসবেন তখন ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। এজন্য চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ছাড়া যেসব হাসপাতালের ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলোকে আগে দ্রুততার সঙ্গে সংস্কার করার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান মানবজমিনকে বলেন, যেকোনো দুর্যোগের ঘটনায় রোগীর চেয়ে অ- রোরীরা বেশি ভিড় করেন হাসপাতালে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ২১শে নভেম্বরের ভূমিকম্পনের পর আমরা সেবা দিতে সক্ষম হয়েছি। হতাহতদের চিকিৎসায় দেশের সব হাসপাতালে জরুরি মেডিকেল টিম কাজ করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি সরাসরি মনিটর করছে। তবে ভবিষ্যতে বড় ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায়  রেড ক্রিসেন্টের সহযোগিতা চাইবেন তারা। এজন্য খুব শিগগিরই সংস্থাটির সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে জানান পরিচালক। এ ছাড়া কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তিনি।