Image description

তৃণমূল পর্যায়ে কর্মীদের চাঁদাবাজি ও দখল এখন অনেক রাজনৈতিক দলের জন্য বড় সমস্যা। এটি দলগুলোর সুনাম ও শৃঙ্খলা নষ্ট করছে। এসব কাজ আমাদের সমাজের সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, তাই এগুলো দূর করা সহজ নয়। তবে এই সমস্যাগুলো উপেক্ষা করলে দলগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা আরও কমে যাবে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এবং মধ্যবিত্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভোটারদের মধ্যে। 

এই সমস্যার সমাধান করতে হলে, চাঁদাবাজি ও দখলের সমস্যা কীভাবে তৈরি হয় তা ভালোভাবে বোঝা জরুরি। এটি বলার মানে এই নয় যে এই কাজগুলো ঠিক, বরং কেন এগুলো চলছে এবং কীভাবে এগুলো বন্ধ করা সম্ভব তা বোঝার জন্য। যেমন, একটি গ্লাসে পানি অর্ধেক আছে নাকি অর্ধেক নেই তা বোঝার জন্য শুধু পানি দেখলে হবে না, পুরো গ্লাসটা দেখতে হবে। তেমনি, সমস্যার গভীরে লুকিয়ে থাকা কারণগুলো না বুঝে এর সমাধান করা সম্ভব নয়। যদি সমস্যার প্রতিটি দিক খুঁটিয়ে দেখা হয়, তবে এর টেকসই সমাধান পাওয়া সম্ভব। এই লেখাটি দুই পর্বের একটি সিরিজের প্রথম পর্ব ‘সমস্যার শিকড় বোঝা’, যেখানে সমস্যার কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে এর সমাধানের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

সাংস্কৃতিক বাস্তবতা: চাঁদাবাজির স্বাভাবিকীকরণ

সমাজের অনেক ক্ষেত্রে, চাঁদাবাজি একটি অপরাধমূলক কাজ থেকে স্বাভাবিক রীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এটি এমন একটি কাজ হিসেবে দেখা হয়, যা অদক্ষ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমে চলার জন্য প্রয়োজনীয়, রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য অপরিহার্য, এবং স্থানীয় প্রভাব ধরে রাখার জন্য অপরিহার্য। এই স্বাভাবিকীকরণের মূল কারণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা এবং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পৃষ্ঠপোষকতা এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ঐতিহ্য। এই সমস্যার গভীরতা বোঝার জন্য সাংস্কৃতিক বাস্তবতাগুলো বিশ্লেষণ করা জরুরি, এবং নিচে উদাহরণের মাধ্যমে এটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ক. পৃষ্ঠপোষকতা এবং স্থানীয় নেতৃত্ব

তৃণমূল নেতারা প্রায়ই তাদের সম্প্রদায় এবং ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন। তাদের ভূমিকা হলো স্থানীয় প্রভাব বজায় রাখা এবং উপরস্থ নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করা। এই প্রক্রিয়ায়, চাঁদাবাজিকে প্রায়শই কার্যকর একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়।

উদাহরণ ১: স্থানীয় ইভেন্ট এবং প্রচারণার জন্য তহবিল সংগ্রহঃ একজন তৃণমূল নেতা স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা দোকানদারদের কাছ থেকে "চাঁদা" দাবি করতে পারেন, যা রাজনৈতিক মিছিল, উৎসব বা দাতব্য কার্যক্রমে ব্যয় হয়। যেমন, একজন ছোট ব্যবসায়ী কোনো দলের প্রচারণা অনুষ্ঠানে আর্থিক অবদান রাখেন কেবলমাত্র তাদের গ্রাহকদের হারানোর ভয়ে বা পরোক্ষ চাপ থেকে রক্ষা পেতে।

উদাহরণ ২: আনুগত্য নিশ্চিত করাঃ তৃণমূল নেতারা তাদের অবস্থান ও প্রভাব বজায় রাখতে চাঁদাবাজি থেকে সংগৃহীত অর্থ ব্যবহার করেন। যেমন, কোনো বাসিন্দার চিকিৎসার খরচ, স্কুলের বেতন বা আইনি সহায়তার জন্য অর্থ প্রদান করা। এতে নেতার প্রতি একটি সরবরাহকারীর ভাবমূর্তি তৈরি হয় এবং চাঁদাবাজি "প্রয়োজনীয় কাজ" হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়।

উপরোক্ত ব্যবস্থার মধ্যে অনেকের কাছে চাঁদাবাজি আর ভুল বা অন্যায় মনে হয় না। এটা মনে করা হয়, এলাকার নেতা তাদের জন্য কাজ করছেন, আর চাঁদা দেওয়া তারই একটি অংশ। এই কারণে চাঁদাবাজির অভ্যাস সমাজে আরও গেঁথে গেছে এবং সহজে বন্ধ করা কঠিন।

খ. পারস্পরিক নির্ভরশীলতা: তৃণমূল পর্যায়ে সম্পর্কের বাস্তবতা

তৃণমূল পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক প্রায়ই পারস্পরিক প্রত্যাশার ওপর নির্ভরশীল। আর্থিক সাহায্য বা "চাঁদা"কে অনেক সময় লেনদেন হিসেবে দেখা হয়, যেখানে উভয় পক্ষই এর থেকে লাভবান হয়। এই পারস্পরিক সম্পর্ক চাঁদাবাজির নৈতিক দিকগুলোকে আরও জটিল করে তোলে।

উদাহরণ ১: স্থানীয় ব্যবসা রক্ষা করাঃ একজন দোকানদার শহরের বাজারে মাসিক ভিত্তিতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকে অর্থ প্রদান করেন। এর বিনিময়ে, ওই নেতা পুলিশি হয়রানি, লাইসেন্স চেক, বা উচ্ছেদের মতো সমস্যাগুলো থেকে দোকানদারকে রক্ষা করেন। যদিও এটি চাঁদাবাজি, দোকানদার এটিকে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার "প্রয়োজনীয় খরচ" হিসেবে মনে করেন। অন্যদিকে, নেতা এটিকে তার সেবা প্রদানের ফি হিসেবে দেখেন।

উদাহরণ ২: হয়রানি এড়ানোঃ রিকশাচালক প্রতিদিন স্থানীয় নেতাকে কিছু টাকা দেন, যাতে তিনি স্থানীয় প্রশাসন বা প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের হয়রানি এড়াতে পারেন। এই ব্যবস্থায় চাঁদাবাজির ধারণাটি অনেকটাই "অবৈধ বীমা"র মতো মনে হয়।

উদাহরণ ৩: সংকটকালে কমিউনিটির সহায়তাঃ বন্যা, অগ্নিকাণ্ড বা রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়, স্থানীয় নেতারা এই চাঁদার অর্থ দিয়ে জরুরি ত্রাণ যেমন খাবার বিতরণ বা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। কমিউনিটির মানুষ, যারা সরাসরি এই সুবিধাগুলো পান, চাঁদাবাজির অনৈতিক দিকটি অনেক সময় উপেক্ষা করেন।

উদাহরণ ৪: ক্ষমতাকে মান্য করাঃ মানুষ প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে, কারণ এতে তাদের সুবিধা হয়। তারা মনে করে, ক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গে থাকলে তারা সুরক্ষিত থাকবে। উদাহরণ: একজন রিকশাচালক স্থানীয় নেতাকে টাকা দেন, যাতে তিনি পুলিশ বা অন্য কোনো ঝামেলা থেকে বাঁচতে পারেন। নেতার ক্ষমতা তাকে কাজ চালাতে সহায়তা করে।

তৃণমূল পর্যায়ের জন্য এই ব্যবস্থা প্রায়ই কার্যকর সমাধান বলে মনে হয়, বিশেষ করে যেখানে সরকারি সেবা বা আইন প্রয়োগ ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত বা অকার্যকর। মানুষ তাদের আর্থিক অবদানকে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার জায়গায় স্থানীয় নেতার সেবা হিসেবে দেখে। সাংস্কৃতিকভাবে এই চর্চাগুলোকে "এভাবেই কাজ হয়" বা "সবাই এটাই করে" বলে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া হয়। এটি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে চাঁদাবাজি চ্যালেঞ্জ করার প্রয়োজনীয়তাও অনেক সময় মনে হয় না, বরং এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে স্থায়ী হয়ে যায়।

গ.  আর্থিক বাস্তবতা: অর্থনৈতিক চাপ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা

চাঁদাবাজি এবং অবৈধ দখলের একটি বড় কারণ হলো আর্থিক অনিরাপত্তা। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের জন্য, যারা পার্টির কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে চাপে পড়েন। বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দলের তহবিল সংগ্রহের কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা না থাকায় এই সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তিগত এবং কর্পোরেট অনুদান বা সদস্য ফি থেকে বড় অঙ্কের তহবিল সংগ্রহ করে। এই প্রক্রিয়াগুলো স্বচ্ছ এবং নিয়মতান্ত্রিক। বিপরীতে, বাংলাদেশের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের উদ্যোগে মিছিল, সমাবেশ বা প্রচারণার জন্য খরচ জোগাড় করতে হয়। এটি অনেক সময় চাঁদাবাজির ওপর নির্ভরশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তৃণমূল পর্যায়ের অনেক কর্মী এবং নেতা বহু বছর ধরে রাজনৈতিক নির্যাতন, চাকরি হারানো এবং কারাবাসের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলে, তারা পার্টির দীর্ঘমেয়াদি ভাবমূর্তি নিয়ে না ভেবে নিজেদের আর্থিক নিরাপত্তার দিকে বেশি মনোযোগ দেন। উদাহরণ: যে তৃণমূল কর্মী বছরের পর বছর লুকিয়ে ছিলেন বা জেলে কাটিয়েছেন, তারা ক্ষমতার পালাবদলের পর সেই প্রভাব কাজে লাগিয়ে নিজেদের আর্থিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চান। তারা জানেন যে এটি দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, কিন্তু পরিবারের শিক্ষা বা পুনর্গঠনের প্রয়োজন তাদের কাছে অগ্রাধিকার পায়।

দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তৃণমূল নেতাদের রাজনৈতিক কঠিন সময়ে সমর্থন করতে ব্যর্থ হলে, তারা নিজেরাই চাঁদাবাজি বা অনৈতিক কাজের দিকে ঝুঁকে পড়েন। উদাহরণ: কোনো তৃণমূল নেতা যদি দলীয় সমর্থন ছাড়া মিছিল বা প্রচারণার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা দাবি করেন, তবে এটি প্রমাণ করে যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অর্থনৈতিক সহায়তার অভাব তাদের এমন অবস্থানে ঠেলে দেয়। এই আর্থিক বাস্তবতাগুলো চাঁদাবাজি এবং অবৈধ দখলের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। দলগুলো যদি তৃণমূল পর্যায়ে সঠিক তহবিল সরবরাহ বা সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে এই প্রবণতাগুলো বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

ঘ.  স্থানীয় বাস্তবতা এবং নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ: চাঁদাবাজির সাথে সংযোগ

নিয়মিত কাউন্সিলের অভাব তৃণমূল পর্যায়ে চাঁদাবাজি এবং অনৈতিক কার্যকলাপের প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। স্থানীয় নেতারা যখন কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত হন না, তখন তাদের কার্যক্রম কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজরদারি ছাড়াই চলতে থাকে। এতে জবাবদিহিতা কমে যায় এবং স্থানীয় নেতৃত্ব নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে চাঁদাবাজির মতো অনৈতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন স্থানীয় নেতা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে দলীয় কার্যক্রমের আড়ালে নিজের স্বার্থে তা ব্যবহার করতে পারে। এই ধরনের কার্যকলাপ তৃণমূল পর্যায়ে চাঁদাবাজিকে স্বাভাবিক করে তোলে এবং নেতারা তা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন।

দলের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাবও চাঁদাবাজির একটি বড় কারণ। অনেক সময় নেতারা দীর্ঘ সময় ধরে একপদে থেকে যান এবং তাদের কার্যক্রমের ওপর কোনো ধরনের মূল্যায়ন বা পর্যবেক্ষণ থাকে না। এটি একটি অনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করে, যেখানে নতুন নেতারা পুরনোদের দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করেন। তদুপরি, যখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্থানীয় পর্যায়ের তহবিল ব্যবহারের বিষয়ে নজরদারি করতে ব্যর্থ হয়, তখন এই নেতারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তহবিল সংগ্রহের নামে চাঁদাবাজির আশ্রয় নেন। এর ফলে, নেতৃত্বের অভ্যন্তরে অশান্তি এবং অস্বচ্ছতা চাঁদাবাজির প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

ঙ. স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণের অভাব এবং দলীয় বিভাজনের প্রভাব

অনেক রাজনৈতিক দলের তৃণমূল পর্যায়ের কার্যক্রম তদারকির জন্য স্বাধীন পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থা নেই। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ছাড়া তৃণমূল পর্যায়ের অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায়ই নজরের বাইরে থেকে যায়। এর ফলে স্থানীয় নেতারা চাঁদাবাজি বা ক্ষমতার অপব্যবহার করার সুযোগ পায়, যা দলের শৃঙ্খলা এবং জনসমর্থনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, একটি দল যদি স্থানীয় স্তরে চাঁদাবাজি শনাক্ত বা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা না রাখে, তাহলে এই ধরনের কর্মকাণ্ড দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর আস্থার অভাব সৃষ্টি করে। যখন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা থাকে না, তখন দলীয় কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে, দলীয় অভ্যন্তরে বিভাজন ও দ্বন্দ্ব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠীগুলো নিজেদের স্বার্থে একে অপরের বিরুদ্ধে কাজ করে, যা দলের ঐক্য ও স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করে। বিশেষ করে, আধুনিক সময়ে সামাজিক মাধ্যম এই বিভাজনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে সামাজিক মাধ্যমে চাঁদাবাজির মিথ্যা অভিযোগ ছড়াতে পারে। এর ফলে জনসমক্ষে দলের ভাবমূর্তি দুর্বল হয় এবং দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিভেদ বাড়ে। এমন পরিস্থিতিতে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রায়ই বিভ্রান্ত হয় এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়, যা রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

চ. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম: রাজনৈতিক সততার দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি দ্বিমুখী অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। একদিকে এটি জনসাধারণের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, অন্যদিকে এটি ভুল তথ্য ছড়ানো এবং দলীয় অভ্যন্তরীণ বিরোধকে জটিল করে তুলতে ভূমিকা রাখছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগকে বড় আকারে প্রচার করে, তা সত্য হোক বা মিথ্যা। এই ধরনের অভিযোগ দ্রুত ভাইরাল হয়ে জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা চাঁদাবাজির অভিযোগ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পুরো দলই সমালোচনার মুখে পড়তে পারে, যদিও অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হয়নি।

দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে একে অপরের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করে। এতে দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য নষ্ট হয় এবং জনসমর্থন হ্রাস পায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি গোষ্ঠী শীর্ষ নেতৃত্বের সমর্থন পেতে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা দলের মধ্যে বিভাজন আরও বাড়িয়ে দেয়।

অনেক রাজনৈতিক দল এখনো সামাজিক মাধ্যম ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সুসংগঠিত কৌশল প্রণয়ন করতে পারেনি। এর ফলে, দলের বিরুদ্ধে ছড়ানো ক্ষতিকর গল্পগুলো সময়মতো মোকাবিলা করা সম্ভব হয় না। সামাজিক মাধ্যমের এই দ্বিমুখী প্রভাব রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি একদিকে তাদের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে, অন্যদিকে ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে দলীয় শৃঙ্খলা ও জনসমর্থনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

উপসংহার

এই লেখায় চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনোভাবেই এগুলোকে সমর্থন করার জন্য নয়, বরং সমস্যার গভীরে থাকা সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতাগুলো তুলে ধরার জন্য। এই সমস্যাগুলো পুরোপুরি দূর করতে হলে, রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রথমে তাদের ঘটে যাওয়া প্রেক্ষাপট স্বীকার করতে হবে, যেমন একটি কাঁচের পুরো কাঠামো বিশ্লেষণ করে ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করা হয়। এই বিষয়গুলো বুঝতে না পারলে সমস্যার সমাধান শুধু তলায় তলায় ঘুরপাক খাবে, স্থায়ী সমাধান হবে না।

পরবর্তী পর্বে, সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কী ধরনের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করা হবে।

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার, শিক্ষক ও গবেষক,  নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়