কুমিল্লা-৬ সংসদীয় আসন বিএনপি’র দুর্গ হিসেবে পরিচিত। দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে এখানে প্রচার- প্রচারণা সরগরম। ভোটের মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী। তার সঙ্গে মাঠে প্রচারণায় ব্যস্ত তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও। কিন্তু মাঠে মনিরুল হক চৌধুরীর কর্মী-সমর্থকদের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে দল থেকে মনোনয়ন না পাওয়া আরেক নেতা হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াছিন ও তার সমর্থকদের তৎপরতা। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে তারা নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে বিরোধী পক্ষের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন। তাদের এই তৎপরতায় ক্ষুব্ধ বিএনপি’র তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। হাজী ইয়াছিনও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। তার বিরুদ্ধে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান ও নানা অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ তুলছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
গত ৩রা নভেম্বর বিএনপি’র পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩৭ আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করা হয়। মনোনয়ন প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই কুমিল্লা-৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, সদর দক্ষিণ) আসনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন আমিনুর রশীদ ইয়াছিন ও তার কর্মী-সমর্থকরা।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, একাধিক জরিপ তথ্য ও মাঠের অবস্থান বিবেচনা করেই পরীক্ষিত নেতা মনিরুল হক চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এমন অবস্থায় দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপতথ্য ছড়ানোয় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, দল মনোনীত প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরী যেদিন যে সময় কোনো এলাকায় কর্মসূচি দিচ্ছেন হাজী ইয়াছিনও একই এলাকায় কর্মসূচি দিচ্ছেন। এতে সংঘাত তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ওদিকে হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াছিন মনে করছেন এই আসনে দলীয় মনোনয়ন পরিবর্তন হবে। দলের সিদ্ধান্ত তার পক্ষে আসবে। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও নির্বাচনে লড়তে পারেন এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।
এই আসনে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও কুমিল্লা সিটির জনপ্রিয় মেয়র মনিরুল হক সাক্কু দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। তিনি তার কর্মী-সমর্থকদেরও ধানের শীষের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
ওদিকে বিএনপি’র স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াছিন মহানগরের কাউকে না জানিয়ে নিজস্ব ঘনিষ্ঠদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করায় স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষোভ ও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। দলের ভেতর চলমান এই কোন্দলের জেরে সাবেক সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, হাজী ইয়াছিন মনোনয়ন পেলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন।
দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে মনিরুল হক সাক্কু মানবজমিনকে বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যাকে ভালো মনে করেছেন তাকেই মনোনয়ন দিয়েছেন। এখানে আমাদের কিছু বলার নেই। যিনি ধানের শীষের প্রার্থী হবেন আমরা তার জন্য কাজ করবো। সাক্কু বলেন, দলীয় নেতাদের উচিত যার যার অবস্থান মাথায় রেখে কাজ করা যাতে দলের ক্ষতি না হয়। তিনি বলেন, মনিরুল হক চৌধুরী বিএনপিতে আসার পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি একজন নির্যাতিত নেতা।
ওদিকে মনিরুল হক সাক্কু সরাসরি মাঠে যুক্ত হওয়ায় দলীয় প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরীর অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে। সাক্কুর ভোটব্যাংক ও জনপ্রিয়তাকে গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখেন স্থানীয় নেতাকর্মী ও ভোটাররা। কারণ আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী আমলেও সাক্কু বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেন।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র যুগ্ম-আহ্বায়ক নজরুল ভূঁইয়া স্বপন মানবজমিনকে বলেন, ধানের শীষ যেদিকে যাবে, এই আসনের জনগণ সেদিকেই ভোট দেবে। হাজী ইয়াছিনের তৎপরতা ধানের শীষের ভোটে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও মনিরুল হক চৌধুরীর প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। কোটবাড়ি এলাকার অলি উল্লাহ বলেন, তৃণমূলের বিএনপিতে মনিরুল হক চৌধুরী জনপ্রিয়। ইয়াছিন সাহেবও দলের নেতা। এখন তার দলের নির্দেশনা মেনে নেয়া উচিত। কালিরবাজার এলাকার মাসুম রানা বলেন, মনিরুল হক চৌধুরী জনপ্রিয় প্রবীণ নেতা। দল তাকে মনোনীত করেছেন। হয়তো ইয়াছিন সাহেবকে সামনে দল অন্য কোনো সুযোগ দেবে।
শহরের কান্দিরপাড় এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, মহানগরে এখন বেশির ভাগ নেতাকর্মী মনিরুল হক চৌধুরীর পক্ষে গণসংযোগ করছেন। হয়তো মনোমালিন্য দূর হলে ইয়াছিনও অংশ নেবেন।
কাওছার হোসেন বিশ্বরোড এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, এ আসনে মনিরুল হক চৌধুরীর বিকল্প নেই।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আবুল বাশার মানবজমিনকে বলেন, মনিরুল হক চৌধুরী দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ। কুমিল্লা শহরের ৮০ ভাগ নেতাকর্মীরা তার পক্ষে প্রচারণা, গণসংযোগ করছেন। কুমিল্লায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান সবচেয়ে বেশি। তার চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু নেই।
কুমিল্লা মহানগর বিএনপি’র সভাপতি উদবাদুল বারী আবু মানবজমিনকে বলেন, কুমিল্লা-৬ সদর আসন বরাবরই আমাদের বিএনপির ঘাঁটি, খালেদা জিয়ার ঘাঁটি। এখানে যখনই সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে তখনই বিএনপি’র মনোনীত প্রার্থী নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। ২০২৬ সালের নির্বাচনে ধানের শীষে মনোনীত প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হবেন। বিএনপি অনেক বড় দল, এখানে হাজার যোগ্যতাসম্পন্ন নেতাকর্মী আছে, এখানে একের অধিক প্রার্থী থাকা স্বাভাবিক। দিনশেষে ধানের শীষ যার হাতে বিএনপিসহ কুমিল্লার সর্বস্তরের জনগণ তার সঙ্গে।
বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। আমি নেতাকর্মীদের বলছি, আসুন ভেদাভেদ ভুলে সবাই ধানের শীষের পক্ষে কাজ করি। বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আমরা কুমিল্লা-৬ আসন বিএনপিকে উপহার দেবো।
তিনি বলেন, আমি বিভক্তির রাজনীতি চাই না। বিএনপি এবং ধানের শীষের স্বার্থে সবাইকে এখন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়। আমি নির্বাচিত হলে দলের ঐক্য দৃঢ় করার চেষ্টা করবো। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফার ভিত্তিতে আমার নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবো।
মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াছিন বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কোনো অবস্থান না নিতে বলেছেন। দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কর্মসূচি পালন করলে সারা দেশে খারাপ বার্তা যাবে তিনি এমনটাও বলেছেন। দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলীয় মনোনয়ন তো চূড়ান্ত না, বদল হতে পারে। দলীয় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে নির্বাচন করবেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার বয়স সত্তর হয়ে গেছে। আমার তো আর অপেক্ষার সুযোগ নেই।