শুক্র ও শনিবার দুইদিনে ছোট-বড় ৪টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে দেশে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭, ৩ দশমিক ৩, ৩ দশমিক ৭ ও সর্বশেষ ৪ দশমিক ৩। যার কম্পনে কেঁপে ওঠে পুরো দেশ। শিশুসহ ১১ জনের প্রাণহানি, শতাধিক আহতসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক। একের পর এক এই ভূমিকম্পে আতঙ্ক বিরাজ করছে রাজধানীবাসীর মধ্যে। সবচেয়ে বেশি শঙ্কা কাজ করছে ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার অভিযান নিয়ে। এরই মধ্যে প্রশ্ন ওঠেছে উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সক্ষমতা নিয়ে। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- বড় ভূমিকম্পের ফলে দেশে মেগা ডিজাস্টার হলে হেভি ইক্যুইপমেন্ট (ভারী যন্ত্রাংশ) ও জনবলের অভাবে উদ্ধার অভিযানই চালাতে পারবে না ফায়ার সার্ভিস।
ভূমিকম্প, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যেকোনো দুর্ঘটনায় উদ্ধারকাজে যারা নেতৃত্ব দেয় সেই বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, বৃহৎ আকারের ভূমিকম্প হলে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজ একত্রে করতে হবে ফায়ার সার্ভিসকে। কেননা, ভবনের গ্যাসের লাইন ফেটে আগুন ছড়িয়ে যাবে। রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগও। আর এই উদ্ধার অভিযান চালানোর মতো তেমন কোনো ভারী যন্ত্রপাতি বা লোকবল কোনোটাই নেই ফায়ার সার্ভিসের।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলেছে, সারা দেশে ফায়ার সার্ভিসের ৫৩৭টি স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে আছে ১৮টি স্টেশন ও মিরপুর দশ নম্বর ও পূর্বাচলে দু’টি বিশেষ টিম। এসব স্টেশন মিলে সারা দেশে ফায়ার সার্ভিসের মোট জনবল মাত্র ১৪ হাজার ৫৬০ জন। এর মধ্যে ঢাকার ১৮টি স্টেশনগুলোতে জনবল ৬৫০ জন। ভূমিকম্পের পর উদ্ধার অভিযানের জন্য-সার্চ ভিশন ক্যামেরা, রোটারি রেসকিউ ‘স’, চিপিং হ্যামার, রেসিপ্রোকেটিং ‘স’ ও চেইন ‘স’, হাইড্রোলিক কাটার, হাইড্রোলিক স্প্রেডার, হাইড্রোলিক র্যাম, এয়ার লিফটিং ব্যাগসহ প্রয়োজনীয় ভারী যন্ত্রাংশের সংখ্যাও সীমিত। ঢাকায় ২১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ১৮ স্টেশনের এইসব ইক্যুইপমেন্ট দিয়ে মাত্র ২০ থেকে ২৫টি ধসে পড়া ভবনেই উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব। ফলে বড় ভূমিকম্প হলে মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়বে রাজধানী।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক মেজর (অব.) এ. কে. এম সাকিল নেওয়াজ বলেন, এই ৫ মাত্রার ভূমিকম্পেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে ৯-এ যাওয়া লাগবে না ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার কেউ উদ্ধারকাজ চালাতে পারবে না। ঢাকার বাইরে থেকে লোক এনে ঢাকায় উদ্ধারকাজ চালাতে হবে। আর মেইন শকের পরে আফটার শক তো আছেই।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রি. জে. (অব.) আবু নাঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, বেতনভুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এটা উন্নত দেশের পক্ষেও সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন ভলান্টিয়ার। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসে ৬২ হাজার আরবান কমিউনিটি ভলান্টিয়ার তৈরি করার চেষ্টা করেছিলাম। কতো চিঠি চালাচালির পর যতগুলো সিটি করপোরেশন ও ওয়ার্ড আছে সবগুলোতে ২০০ জন করে এবং ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টাসে ২০০ জন করে মোট ৪০ হাজারের মতো ভলান্টিয়ার তৈরিও হয়েছিল। বর্তমানে দুই থেকে তিন লাখ ভলান্টিয়ার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভলান্টিয়ারদের ইক্যুইপমেন্ট কেনা তো দূরের কথা এখনো সেই ৬২ হাজারই পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সিনিয়র স্টাফ অফিসার ও বর্তমান মিডিয়া শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ডিসেন্ট্রালাইজ করা হয়েছে যেন একটি ভবন ভেঙে পড়লে সব কর্মকর্তা আটকে না যায়, কমান্ড ফেল না করে। একই সঙ্গে জেলা পর্যায়সহ আমাদের সব স্টেশনে ভূমিকম্পে উদ্ধারকাজ করার মতো ইক্যুইপমেন্ট রাখা আছে। ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য ৬২ হাজার ভলান্টিয়ার ডেভেলপ করেছি যার মধ্যে ৫৫ হাজার অলরেডি প্রস্তুতও রয়েছে। পূর্বাচলেও ৬০ ইক্যুইপমেন্টসহ ৬০ জনের একটি টিম রেডি করা আছে। তবে মেগা ডিজাস্টার হলে সেটি মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত জনবল আমাদের নেই। এটা উন্নত দেশেও নেই। এটার জন্য আমাদের দেশের যে এসওডি অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড অর্ডার অ্যান্ড ডিজাস্টারের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ সব বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করে। যেকোনো দুর্যোগেই এটিই করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ত্রাণ কর্মসূচি অধিশাখা, জরুরি সাড়াদান ও সমন্বয় অধিশাখার যুগ্ম সচিব সেখ ফরিদ আহমেদ বলেন, বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও আনসারের মতো প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত থাকলেও আমাদের এই বর্তমান সক্ষমতা একটি বৃহৎ মাত্রার ভূমিকম্প মোকাবিলায় পর্যাপ্ত নয়, এই সত্য আমাদের স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই। ভূমিকম্পের সময় জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিও রয়েছে। তবে ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার আইন ও নীতিগত কাঠামো প্রণয়নে বদ্ধপরিকর। ভূমিকম্প সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা এবং বিশেষত বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা একটি নিরাপদ অবকাঠামো নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। এই বিশাল সমস্যার সমাধানে শুধু রাষ্ট্রের ভূমিকা নয়, একটি সার্বিক ও সমন্বিত পদ্ধতি অপরিহার্য। শুধু রাষ্ট্রকে দোষারোপ না করে আমাদের প্রতিটি নাগরিককেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।