দেশে সাম্প্রতিক সময়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এদিকে, জুলাই আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে লুট হওয়া ১ হাজার ৩০০-এরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি; যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং অপরাধ বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ‘টার্গেট কিলিংয়ের’ ঘটনা বাড়ছে উল্লেখ করে এর পেছনে লুট হওয়া অস্ত্রের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশি স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। এদিন সবচেয়ে বেশি অস্ত্র লুট হয়।
পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, থানা, ফাঁড়ি ও গাড়ি থেকে মোট ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র লুট করা হয়েছে।
এর মধ্যে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে পরিচালিত যৌথ অভিযানে ৪ হাজার ৩৯০টি অস্ত্র উদ্ধার করা গেছে। তবে কমপক্ষে ১ হাজার ৩৪৪টি অস্ত্র এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কারা অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, জুলাই আন্দোলনের সময় নরসিংদী ও শেরপুর কারাগার থেকে ৯৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে ৬৭টি উদ্ধার করা হয়েছে; বাকি ২৭টির এখনও হদিস পাওয়া যায়নি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, নিখোঁজ অস্ত্রগুলো সহিংসতা বাড়াচ্ছে এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডে সেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।
‘এসব অস্ত্র এখন সংগঠিত অপরাধী চক্রের হাতে এবং এগুলো ব্যবহার করে টার্গেট কিলিং চালানো হচ্ছে’ বলে জানান মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. ওমর ফারুক।
বাড়ছে টার্গেট কিলিং
১৭ নভেম্বর রাজধানীর পল্লবীতে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে, পুরান ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। চট্টগ্রামে বিএনপির এক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সময় ‘সন্ত্রাসী’ সারোয়ার হোসেন ওরফে বাবলাকে হত্যা করা হয় কয়েক দিন আগেই। ১৬ নভেম্বর খুলনার করিমনগরে আলাউদ্দিন মৃধাকে তার বাড়ির ভেতর গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
পুলিশ সূত্র ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো সমন্বিতভাবে পরিচালিত টার্গেট কিলিং, যার সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক জড়িত।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, গত ১০ মাসে রাজধানীতে ১৯৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। অর্থাৎ, মাসে গড়ে প্রায় ২০টি হত্যাকাণ্ড ঘটছে ঢাকায়।
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ১৯টি গুলিতে, ১৪টি নির্যাতনে এবং ৭টি পিটুনিতে মৃত্যু।
‘টার্গেট কিলিং প্রতিরোধ করা যায় না’
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্বীকার করে বলেন, ‘কারও ওপর টার্গেট করে গুলি চালানো হলে পৃথিবীর কোনও দেশেই তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেই। আমরা তদন্ত করতে পারি, গ্রেফতার করতে পারি—কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারি না।’ দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আইজিপি জানান, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার গণঅভ্যুত্থানের আগেও ছিল এবং এখনও তা চলমান।
বাহারুল আলম বলেন, ‘পতেঙ্গা এবং মুন্সীগঞ্জ ছাড়া তেমন কোথাও হত্যাকাণ্ডে লুট হওয়া পুলিশের অস্ত্র ব্যবহার হয়নি; বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রচলিত অবৈধ অস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটছে।’
অধ্যাপক ড. মো. ওমর ফারুক বলেন, “৫ আগস্টের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়ার ফলে দেশ এখন ‘অপরাধীদের অভয়ারণ্য’ হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় পুলিশ ব্যস্ত থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হচ্ছে।’
এই গ্রুপগুলোকে শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করতে সরকারকে কঠোর হওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে অস্ত্রপাচার ঠেকাতে বিজিবিকে নজরদারি বাড়ানোরও পরামর্শ দেন অধ্যাপক ড. মো. ওমর ফারুক।