Image description
ক্যানসারের চেয়েও ভয়ংকর চাঁদাবাজি

৫ আগস্টের পর সবাই আশা করেছিল, নতুন বাংলাদেশে চাঁদাবাজি কমবে, জনজীবনে স্বস্তি আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চাঁদাবাজি কমেনি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেছেন, ‘রাজনৈতিক সমঝোতা করা খুব কঠিন কাজ, সে তুলনায় চাঁদাবাজির সমঝোতা অনেক সহজ।’ তিনি আরও বলেছেন, যখন চাঁদাবাজদের এক দল চলে যায়, তখন অন্য দল অনিবার্যভাবে ওই শূন্যস্থানে চলে আসে। এ পর্যবেক্ষণ একটি গভীরতর ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে চাঁদাবাজি কেবল একটি অপরাধ নয়,  বরং এটি রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখার একটি কৌশলগত হাতিয়ার। এর অর্থ হলো, রাজনৈতিক পালাবদলের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, নতুন সরকার চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে এবং একটি স্বচ্ছ ও সুশাসিত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। চাঁদাবাজির চক্র এখনো সক্রিয়। কেবল এর চেহারা এবং নিয়ন্ত্রণকারীদের হাতবদল হয়েছে মাত্র। একটি চক্রের পতনের পর অন্য একটি চক্র সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে চাঁদাবাজি কেবল নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের সমস্যা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি গভীর প্রোথিত কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরে ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল/স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন আনুমানিক ২.২১ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়, যা মাসিক ৬০-৮০ কোটি টাকায় পৌঁছায়। সারা দেশে বাস ও মিনিবাস খাত থেকে বছরে প্রায় ১, ০৫৯ কোটি টাকা অবৈধভাবে আদায় করা হয়। হাট-বাজারের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজির শিকার হন, যার পেছনে স্থানীয় রাজনীতি ও তথাকথিত সংগঠনগুলোর ছত্রছায়া কাজ করে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে পণ্য সরবরাহ বন্ধ, ব্যবসা বন্ধের হুমকি বা সরাসরি হামলার মুখোমুখি হতে হয়। সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, টেন্ডার, নির্মাণকাজ, জলমহাল ও বালুমহালের ইজারা- সবখানেই দলীয় ও প্রশাসনিক মদতপুষ্ট চাঁদাবাজ চক্র সক্রিয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্য অনুযায়ী, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি)-তে ২০০৯-২০২৩ সালের মধ্যে ১৩-২৪ বিলিয়ন ডলার (১.৬১-২.৮০ লাখ কোটি টাকা) দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির কারণে নষ্ট হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদাবাজির ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাঁচটি গোষ্ঠী চাঁদাবাজির সঙ্গে সরাসরি জড়িত-

১) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কতিপয় ব্যক্তি।

২) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ।

৩) প্রশাসনে থাকা কতিপয় ব্যক্তি।

৪) সন্ত্রাসী গোষ্ঠী

৫) বিচ্ছিন্নভাবে চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি হচ্ছে রাজনৈতিক পরিচয়ে বা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি। গত ১৫ মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মোট ২ হাজার ৩২৫টি চাঁদাবাজির ঘটনার খবর পাওয়া যায়, যার সঙ্গে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীরা জড়িত। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ছোটখাটো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যায়। কিছুকিছু চাঁদাবাজির ঘটনায় তোলপাড় হয়। যেমন- ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে শরীয়তপুর রুটে চলাচল করা শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস নামের একটি পরিবহন কোম্পানির কাছে ৫ কোটি টাকা অথবা মাসে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির একটি অভিযোগ ওঠে চলতি মাসে।

টাকা না পেয়ে ওই পরিবহনের বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আটই জুলাই থেকে তিন-চার দিন যাত্রাবাড়ী থেকে শরীয়তপুর সুপার সার্ভিসের বাস চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বাসের কর্মচারীদেরও মারধর করার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার প্রতিবাদে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে টোল প্লাজার কাছে সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন হয়।

শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস পরিবহনে চাঁদা দাবির এ অভিযোগ ওঠে যাত্রাবাড়ী থানা যুবদলের একজন পদধারি নেতার বিরুদ্ধে। ১২ জুলাই তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে বিজ্ঞপ্তি দেয় সংগঠনটি।

দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনিব্যবস্থা গ্রহণেরও আহ্বান জানানোর কথা উল্লেখ করা হয় সংগঠনের পক্ষে। গত ১১ মাসে চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও হামলার নানা অভিযোগে ৪ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে বহিষ্কারও করেছে বিএনপি। কিন্তু তার পরও বন্ধ হয়নি চাঁদাবাজি। জামায়াতের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। রংপুরের তারাগঞ্জে ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের এক অফিস সহায়কের ঘুষ গ্রহণের ভিডিও ধারণের পর সেই ভিডিও দিয়ে জিম্মি করে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছে বিএনপি। নাটোরে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে কর্মসূচি পালন করে স্থানীয় জনগণ।

সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে এক ব্যবসায়ীর কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ কাজীপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ‘চাঁদা না পেয়ে’ বাস টার্মিনালের ইজারাদারের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।

চাঁদাবাজি ও হত্যাচেষ্টার লিখিত অভিযোগ পেয়ে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন কুমারখালী থানার ওসি সোলাইমান শেখ। জামালপুরের মেলান্দহে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তা পরিচয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল সোমবার (১৭ মার্চ) বিকালে উপজেলার নাংলা ইউনিয়নের হরিপুর এলাকা থেকে তাকে আটক করে পুলিশ। অভিযুক্ত সাজ্জাদ হোসেন সাকিব জামায়াতে ইসলামীর নেতা সামিউল হক ফারুকীর ভাতিজা বলে দাবি করা হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের মামলার হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে মেহেদী হাসান তুষার নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে। সে নিজেকে জামায়াত কর্মী দাবি করলেও জামায়াত বলছে তুষার জামায়াতের কেউ নয়।

জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকা তরুণদের ছাত্রদের সংগঠন এনসিপির বিরুদ্ধেও আছে চাঁদাবাজির অনেক অভিযোগ। চাঁদাবাজির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কিছু নেতা আটক হয়েছেন, সমালোচিত হয়েছেন, অনেকের বিরুদ্ধে তদন্তও হচ্ছে। এনসিপির কয়েক জন নেতা গত কয়েক মাসে নানা ঘটনায় আলোচনায় এসেছেন। যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে গত এপ্রিলে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। ঢাকার ধানমন্ডির একটি বাড়িতে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে মব হামলার পর আটকদের থানা থেকে ছাড়িয়ে এনে আলোচনায় এসেছিলেন এনসিপির আরেকজন নেতা আবদুল হান্নান মাসুদ। গত বছর আগস্টের পর থেকে সারা দেশেই সমন্বয়ক পরিচয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন, চাঁদাবাজি, তদবিরসহ নানা অভিযোগ আসতে থাকে। চাঁদাবাজির অভিযোগে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চট্টগ্রাম মহানগর শাখার নতুন কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী নিজাম উদ্দিনকে শোকজ করা হয়েছে। সোমবার (১১ আগস্ট) এনসিপি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার যুগ্ম সমন্বয়কারী (দপ্তর) আরিফ মঈনুদ্দিনের সই করা একটি চিঠিতে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এরকম বহু চাঁদাবাজির অভিযোগ জর্জরিত এনসিপি। এ ছাড়া অনেক ছোট দলের নেতাদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ এখন যেন এক স্বাভাবিক ঘটনা।