মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠক শুরু হয়েছে আগেই। প্রার্থী ও সমর্থকরা ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছেন। নিজ নিজ দলের পক্ষে ভোট চাইছেন। গোপালগঞ্জের বর্তমান চিত্র এমনই। তবে আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জ জেলায় এবার মাঠে নেই নৌকার প্রার্থী। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদেরও প্রকাশ্যে দেখা নেই। এ অবস্থায় বিএনপি ও জামায়াত গোপালগঞ্জের রাজনীতিতে এখন চাঙ্গা। দু’টি দলই চাইছে গোপালগঞ্জে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে। তাই নানা কৌশলে তারা নেমেছে নির্বাচনী প্রচারণায়। ভোটারদের দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। প্রতিটি হাট-বাজার, পাড়া-মহল্লায় টাঙ্গানো হয়েছে পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন। বলা যায় নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি ও জামায়াত এখন মুখোমুখি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হিসেবে গোপালগঞ্জ সব সময়ই আলোচিত। আর তার কন্যা শেখ হাসিনা এ আলোচনাকে আরও একধাপ এগিয়ে দিয়েছেন ক্ষমতার মসনদ থেকে পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়ে। এ ছাড়া সরকার প্রধান হিসেবে তার ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন ও সর্বশেষ জুলাই-আগস্টে গণহত্যার ঘটনায় লজ্জিত গোপালগঞ্জের অধিকাংশ মানুষ। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই গোপালগঞ্জে। একেবারে নীরব, নিস্তব্ধ। সোমবারও বিএনপি ও জামায়াতের নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত ছিল সর্বত্র। তিনটি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত গোপালগঞ্জ জেলা। মুকসুদপুর উপজেলা ও কাশিয়ানী উপজেলার আংশিক নিয়ে গোপালগঞ্জ-১ আসন। কাশিয়ানীর আংশিক ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নিয়ে গোপালগঞ্জ-২ আসন এবং টুঙ্গীপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলা নিয়ে গোপালগঞ্জ-৩ আসন গঠিত। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। আর গোপালগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে ও শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম। গোপালগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল ফারুক খান। স্বাধীনতার পর ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনে জেলার তিনটি আসনেই জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ছিলেন- গোপালগঞ্জ-৩ আসনে কাজী ফিরোজ রশীদ।
গোপালগঞ্জ-২ আসনে ফরিদ আহাম্মেদ দাড়িয়া। আর গোপালগঞ্জ-১ আসনে এম এইচ খান মঞ্জু। যেহেতু আওয়ামী লীগ মাঠে নেই; তাই গোপালগঞ্জে বিএনপি ও জামায়াত রয়েছে ফুরফুরে মেজাজে। আবার তারা নির্বাচনী মাঠে মুখোমুখিও। সাধারণ মানুষের কথা- যদি জেলার তিনটি আসনেই ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয় তাহলে নির্বাচনী খেলা অন্যদিকে মোড় নিতে পারে।
গতবছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গীপাড়ার সন্তান শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর গোপালগঞ্জ জেলার তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যায়। ওদিকে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করায় তারা নির্বাচন করতে পারছে না। আর যারা নির্বাচন করবেন বেশির ভাগ নেতাই দেশ থেকে পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ফলে ত্রয়োদশ নির্বাচনে জেলার তিনটি সংসদীয় আসন আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হবে। আর এই সুযোগটিই নিতে মাঠে মরিয়া বিএনপি ও জামায়াত। দু’টি দলের এমপি প্রার্থীরা তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে রাত-দিন নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন।
গোপালগঞ্জ-১, ২ ও ৩ নং সংসদীয় আসনে জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী থাকলেও দুইটি আসনে বিএনপি’র প্রচারণায় রয়েছে একাধিক প্রার্থী। তবে সামপ্রতিক সময়ে বিএনপি’র পক্ষ থেকে গোপালগঞ্জের তিনটি সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য একজন করে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। একারণে মনোনয়ন বঞ্চিতরা অসন্তুষ্ট হওয়ায় দলের ভেতরে গড়ে উঠেছে একাধিক গ্রুপিং। অনেকেই মনে করছেন বিএনপি থেকে বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকায় বিএনপি’র তুলনায় কোন্দলমুক্ত অবস্থানে রয়েছে দলটি। গোপালগঞ্জের তিনটি আসনেই বিএনপি, জামায়াত ছাড়াও রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গনঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য দলের প্রার্থী। তবে গোপালগঞ্জে বিএনপি’র তুলনায় জামায়াতের কর্মী, সমর্থক ও ভোটারের ফারাক অনেক। আগের কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপি ৮% ভোট পেলেও জামায়াত ভোট সংখ্যায় কোনো শতাংশই অর্জন করতে পারেনি। এই বিবেচনায় গোপালগঞ্জের তিনটি আসনেই বিএনপি এগিয়ে- বলছে জেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ ভোটাররা।
গোপালগঞ্জ-১ আসনে বিএনপি’র মনোনয়ন পেয়েছেন সেলিমুজ্জামান মোল্লা। জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন আব্দুল হামিদ। গোপালগঞ্জ-২ আসনে বিএনপি’র প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন ডা. কেএম বাবর। জামায়াতের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে এডভোকেট আজমল হোসেনকে। এ ছাড়াও গোপালগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপি’র মনোনয়ন পেয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি এস. এম. জিলানী। এই আসনে জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন মাওলানা রেজাউল করিম।
গোপালগঞ্জ-২ আসনের বিএনপি’র মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি এম সিরাজুল ইসলাম। তিনি মনোনয়ন না পাওয়ায় তার সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ। সিরাজুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি দলের দুর্দিনে কয়েকবার প্রার্থী হয়ে যথেষ্ট ভোট পেয়েছিলাম। এবার আমায় দল মনোনয়ন দিলে গোপালগঞ্জের মানুষ আমাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করতো। দল যাকে সম্ভাব্য মনোনয়ন দিয়েছেন তিনি কখনোই এই জেলায় রাজনীতি করেননি। তাকে মনোনয়ন দেয়ায় স্থানীয় বিএনপি’র নেতাকর্মী ও সমর্থকরা হতাশ হয়েছে। গোপালগঞ্জ-২ আসনের এই সম্ভাব্য মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার জন্য আমি দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। গোপালগঞ্জ-১ আসনেও বিএনপি’র মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন মেজবাহ উদ্দিন। বলেন, মুকসুদপুর-কাশিয়ানীর ভোটাররা আমাকে চায়। যাকে সম্ভাব্য মনোনয়ন দিয়েছে তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে মামলা-হামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করার অভিযোগ রয়েছে। আমি আশা করছি, দল বিষয়টি বিবেচনায় নিবেন। গোপালগঞ্জ-১ ও ২ আসনে বিএনপি’র প্রার্থিতা নিয়ে দলের ভেতরে বিরোধী পক্ষ থাকলেও ৩ আসনের এমপি প্রার্থী এস এম জিলানী একেবারে নির্জলা। এ আসনের নেতাকর্মীরা তাকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছেন। মাঠে প্রচারণা চালাচ্ছেন। অপরদিকে গোপালগঞ্জের তিনটি আসনেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী থাকায় তারা কোন্দলমুক্ত। গোপালগঞ্জের তিনটি আসনের প্রার্থীই বলেছেন, জামায়াতের নীতি ও আদর্শকে ভালোবেসে গোপালগঞ্জের মানুষ জামায়াতের প্রার্থীদের বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে।
নির্বাচন নিয়ে জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক শরীফ রাফিকুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, গোপালগঞ্জের তিনটি আসনেই সবসময় বিএনপি’র সম্মানজনক ভোট ছিল। তবে আওয়ামী লীগের ভোট কেটে নেয়ার সংস্কৃতির জন্য বিএনপি এই জেলায় পেছনে পড়তো। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ অপরাধী সংগঠন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। দলীয় প্রধানসহ সকল স্তরের নেতাকর্মীরা পালিয়েছে; তাই গোপালগঞ্জে বিএনপি’র বিকল্প কোনো রাজনৈতিক দল আছে বলে আমি মনে করি না। বিএনপি’র যেহেতু কয়েকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা রয়েছে তাই এই দলটির প্রতি সাধারণ ভোটারদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও আস্থা রাখবে। তিনি বলেন, এই জেলায় জামায়াতে ইসলামীর কখনোই ভোটের কোনো পার্সেন্টেজ ছিল না। এখন অনেক জামায়াত নেতা ঢাকঢোল পিটিয়ে যে শোডাউন করছে তা শুধু প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ভোটের মাঠে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাবে না। গোপালগঞ্জের মানুষ কখনোই ধর্মান্ধ দলের মার্কায় ভোট দিবে না।
গোপালগঞ্জ প্রেস ক্লাব সভাপতি ও বিশিষ্ট সমাজসেবক মোতাহারুল হক বাবলুর মতে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। যুগ যুগ ধরে এখানকার সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগ ও নৌকা মার্কার প্রতি অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করে আসছে। এ কারণে কোনো নির্বাচনেই অন্যকোনো রাজনৈতিক দল সুবিধা করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী যেহেতু আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারবে না; তাই জেলার তিনটি আসনেই বিএনপি’র জন্য বড় ধরনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বিশেষ করে শেখ হাসিনার আসন গোপালগঞ্জ-৩ এর দিকে দৃষ্টি সবার। ত্রয়োদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আসনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার ও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসএম জিলানী, জামায়াতের গোপালগঞ্জ জেলা আমীর এমএম রেজাউল করিম এবং ইসলামী আন্দোলনের ইঞ্জিনিয়ার মো. মারুফ শেখ ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা হাট-বাজার, পাড়া-মহল্লা ও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে দোয়া প্রার্থনা করছেন। কোটালীপাড়ায় মোট ভোটের অর্ধেকের বেশি হিন্দু ভোটার রয়েছেন। তাই হিন্দু ভোটারদের কাছে টানতে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা অনুষ্ঠানে এসব প্রার্থী উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখছেন। তারা বলছেন- একটি বার আমাকে সংসদে যাবার সুযোগ দিন, কথা দিলাম আমি আপনাদের পাশে থাকবো। হিন্দু- মুসলিম আমরা একে অপরের ভাই। বিএনপি প্রার্থী এসএম জিলানী বলেন- তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত করার চেষ্টা করবেন। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী এমএম রেজাউল করিম বলছেন- আমি সবসময় আপনাদের পাশে থাকবো। জামায়াতের রাজনীতি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি। আপনারা আমাকে নির্বাচিত করলে আমি কোটালীপাড়া ও টুঙ্গীপাড়াকে বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক দুর্নীতি, চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত মডেল উপজেলা হিসেবে গড়ে তুলবো। ওদিকে ইসলামী আন্দোলনের ইঞ্জিনিয়ার মো. মারুফ শেখ উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারসহ পাড়া-মহল্লায় ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।