সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিট। স্পট পল্লবী থানার সি ব্লকের ৫ নম্বর রোড। এখানকার বিক্রমপুর হার্ডওয়্যার অ্যান্ড স্যানিটারি দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলেন পল্লবীর যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়া। কিছুক্ষণের মধ্যে মোটরসাইকেলে করে আসা তিনজন সন্ত্রাসী মাথায় হেলমেট পরে সরাসরি ওই দোকানে প্রবেশ করে। তাদের সবার হাতেই ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাত্র ১০ সেকেন্ডে কিবরিয়াকে খুব কাছ থেকে মাথা, বুক এবং পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে উপর্যুপরি সাত রাউন্ড গুলি ছোড়ে পালিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কিবরিয়া। তখনো সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে। এক পর্যায়ে তারা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আশপাশে থাকা লোকজন এক ব্যক্তিকে আটক করে। এ ছাড়া পালানোর সময় দ্রুত রিকশা না চালানোয় চালককেও গুলি করে তারা। গুলিবিদ্ধ কিবরিয়াকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ আটক ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তবে কী কারণে ওই নেতাকে হত্যা করা হয়েছে সেটি এখনো খোলাসা করছে না পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা বাকি দুজনকে গ্রেপ্তারের পর রহস্য জানা যাবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। যদিও নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে হত্যা করেছে।
শুধু পল্লবীর ওই যুবদল নেতাকে নয় বেশ কিছুদিন ধরে সারা দেশে গুলি করে মানুষ হত্যার ঘটনা বেড়েই চলছে। ঢাকাসহ সারা দেশে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ঘটনার পর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশ জুড়ে চাঞ্চল্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ এসব হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। গত ১১ই নভেম্বর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুনকে। আদালত পাড়ায় মামুনকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ায় বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ হত্যায় ব্যবহৃত সেই আগ্নেয়াস্ত্রসহ পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্যদিকে মামুন হত্যার ঘটনায় একে একে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ডাব খাওয়ানোর কথা বলে মামুনকে হাসপাতালের গেটে ডেকে আনে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী কামাল। জেল থেকে বের হয়ে গত ছয় মাস ধরে মামুনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে এই কামাল। হত্যায় ব্যবহার করা দু’টি পিস্তল কেনা হয় পাঁচ লাখ টাকায়।
দেশ জুড়ে বেশ কয়েকটি গুলি করে হত্যার ঘটনার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি সামনে এসেছে। পুলিশের তরফ থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নাই। কারণ অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন দেশে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বেড়ে যায় ঠিক তখনই অস্ত্র ব্যবহার করে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু ঘটনায় তারই আলামত পাওয়া যাচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভেঙে পড়া পুলিশের দুর্বলতায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি শুরু হয়। যা গত ১৫ মাসেও স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসেনি। পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও নানা কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। গণ-অভ্যুত্থানের পর থানা থেকে লুট হওয়া হাজারের উপরে অস্ত্র এখনো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এগুলোর মধ্যে মারাত্মক মারণাস্ত্রও রয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে নানা উদ্যোগ, অভিযান পরিচালনা করেও এসব অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। শেষতক লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। তবুও কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। ইতিমধ্যে সরকারি এসব অস্ত্র দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশের থানা ও কারাগার থেকে পাঁচ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়েছিল। এর মধ্যে চার হাজার ৪০৮টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৩৪২টি অস্ত্র। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে এসএমজি, অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল ও এলএমজি’র মতো মারণাস্ত্র রয়েছে। শুধু অস্ত্র নয়, ওই সময় অস্ত্রের সঙ্গে গোলাবারুদও লুট হয়েছিল। সেগুলো পুরোপুরি উদ্ধার করা যায়নি। এসব অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে কয়েকগুণ। একদিকে এসব অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ হত্যার ঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে এসব অস্ত্র হাত বদল হয়ে চলে গেছে সন্ত্রাসী, চরমপন্থি, উগ্রবাদী, জঙ্গি, জেল পলাতক সন্ত্রাসীদের কাছে। তাই গোয়েন্দারাও এসব অস্ত্রের হদিস পাচ্ছেন না। এতে করে শঙ্কা রয়ে যায় কোথায়, কখন এসব অস্ত্র ব্যবহার হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, আগামী মাসের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো মাঠ গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিছু কিছু দল তাদের প্রার্থীও নির্বাচন করেছে। পোস্টার লাগিয়ে প্রচার- প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন ঘিরে দলগুলোর তৎপরতা বাড়ায় মাঠে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও মাথাচাড়া দিচ্ছে।
১৫ই নভেম্বর লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতের স্ত্রী এ হত্যাকাণ্ডের জন্য ছাত্রদলের এক কর্মীকে দায়ী করেছেন। পুলিশ ও নিহতের স্বজনদের ধারণা, আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তার স্ত্রী বলেছেন, কামালের সঙ্গে ছাত্রদল কর্মী কাউছার হোসেন ওরফে ছোট কাউছারের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ ছিল। এর জের ধরে কাউছারের লোকজন তার স্বামী কালামকে খুন করেছে। গত মাসে চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিন-দুপুরে বিএনপি সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু নিহত এই ব্যক্তি বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা ও রাউজানের সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে উপজেলা বিএনপি’র দলীয় কোন্দল সামনে এসেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, দেশের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দুই দেশ থেকে অস্ত্র ঢুকছে। সীমান্তের অন্তত ১৮ থেকে ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করে। অস্ত্র চোরাচালানিরা একই রুট ব্যবহার করে দীর্ঘদিন অস্ত্রের চালান নিয়ে আসে না। কারণ ওই রুটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বেড়ে যায়। তাই তারা সুযোগ সুবিধামতো রুট পরিবর্তন করে। আর চোরাচালানের ক্ষেত্রে কারবারিরা নতুন নতুন কৌশলও নেয়। এতে করে সংশ্লিষ্টদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সহজেই চালান নিয়ে আসে দেশে। গোয়েন্দাদের মতে, দেশের সীমান্তের যেসব জেলা দিয়ে অস্ত্রের চালান আসে তার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, যশোর, কুমিল্লা, কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বেশি অস্ত্র আসে। পাহাড়ি অঞ্চল আর সাগরপথ দিয়েও অস্ত্র আনা হয়। বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে এসব পণ্য নিয়ে আসার জন্য দুই প্রান্তেই লোক নিয়োগ করা থাকে। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আনা হচ্ছে- এমন তথ্যের পর সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবুও অস্ত্র ঢুকছে দেশে। চালান দেশে প্রবেশের পরপরই চলে যাচ্ছে অপরাধী, সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে। অবৈধ অস্ত্র প্রবেশের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর বিজিবিও সীমান্তে আগের চেয়ে আরও বেশি নজরদারি বাড়িয়েছে।
সম্প্রতি এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ২৭১ কিলোমিটারের সাতটি পথে পাচারকারীরা অস্ত্র আনছে। এসব পথের পয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি, ঘুমধুম পয়েন্টের বালুখালী কাস্টমস ঘাট ও উখিয়ার পালংখালী এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নলবুনিয়া। বাইশফাঁড়ি এলাকার পথ দুর্গম, গহিন ও পাহাড়ি। এখানকার চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা নৃগোষ্ঠীর লোকজনও অস্ত্র পাচারে জড়িত রয়েছে। এই স্থান দিয়ে বেশির ভাগ অস্ত্র যায় তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্যে থাকা সন্ত্রাসীদের কাছে। অন্য দু’টি পয়েন্ট দিয়ে আনা অস্ত্র যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। এ ছাড়া নাফ নদ দিয়ে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রাং, উলুবুনিয়া ও টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা-দমদমিয়া-জাদিমুরা-নয়াপড়া এবং টেকনাফ সদর ইউনিয়নের বরইতলী খাল দিয়ে আনা হয় অস্ত্র। রোহিঙ্গারাই এসব চোরাই পথের বিভিন্ন স্থান দিয়ে পাচার করে থাকে অস্ত্র। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে দেশে অস্ত্র পাচারে সক্রিয় রয়েছে পাঁচটি চক্র। এ ছাড়াও খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের অরণ্যে থাকা সন্ত্রাসীদের গ্রুপ অস্ত্র চোরাচালান করে থাকে।
এদিকে, সিলেট সীমান্ত দিয়েও অস্ত্রের চালান আসছে দেশে। পুলিশ ও র্যাব ইতিমধ্যে বেশ কিছু রুট শনাক্ত করে নজরদারি বাড়িয়েছে। সিলেটের কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও সুনামগঞ্জের সীমান্তপথ দিয়ে অস্ত্র আনা হয়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই জনপদের তিন দিকেই ভারত সীমান্ত। আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় এই তিন রাজ্যেই উগ্রবাদীদের তৎপরতা বেশি। প্রতিটি উগ্রবাদী সংগঠনই অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। হাত বদল হয়ে তাদের অস্ত্র-বিস্ফোরক অহরহ ঢুকছে সিলেট সীমান্ত দিয়ে। ২০২৩ সালের এপ্রিলেও সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছিল। বিশেষ করে কানাইঘাট সীমান্ত ব্যবহার করে পয়েন্ট টু-টু বোর রিভলবার ও নাইন এমএম পিস্তল বাংলাদেশে আসছে। অনলাইনে অস্ত্র বিক্রির তথ্যও আবিষ্কার করেছে র্যাব। দীর্ঘ গোয়েন্দা তৎপরতার পর অনলাইনে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার করে র্যাব।