মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। পাশাপাশি অভিযোগ গঠনের সময় দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজসাক্ষী হওয়ায় মামুনকে এই নমনীয় সাজা দেওয়া হয়েছে বলে জানান ট্রাইব্যুনাল-১।
২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট মামলার বিষয়ে প্রাপ্ত অভিযোগ থেকে আজ ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৪৬০ দিনে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। আর মামলার রায় দিতে ট্রাইব্যুনাল সময় নেন ১৯৪ মিনিট। মোট ছয়টি অংশে ভাগ করা রায়টি ছিল ৪৫৩ পৃষ্ঠার। ফলে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা এটিই প্রথম মামলার রায় ঘোষণা করলেন ট্রাইব্যুনাল-১।
মামলার প্রাথমিক তথ্য
মামলাটি ছিল আইসিটি বিডি কেস নং ২/২০২৫। এ মামলায় অভিযোগ পাওয়া যায় ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট এবং তদন্ত শুরু হয় একই বছরের ২৯ অক্টোবর থেকে। সে হিসেবে এক বছর এক মাসের মধ্যে মামলাটির রায় পাওয়া গেলো। মামলায় একমাত্র গ্রেফতারকৃত আসামি হিসেবে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে চলতি বছরের ১৬ মার্চ থেকে গ্রেফতার দেখানো হয়। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয় গত ১২ মে। ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয় গত ১ জুন।
সাক্ষ্য দিয়েছেন ৫৪ জন
ফরমাল চার্জের সঙ্গে ১৪ খণ্ডে প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার দালিলিক সাক্ষ্য জমা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে পত্র-পত্রিকা, দেশি ও আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন, শহীদ ও আহতদের তালিকা সংবলিত গেজেট, বই, স্মারকগ্রন্থ, ঘটনাস্থলভিত্তিক আন্দোলনে আহত-নিহতের তালিকা, গাইল ও গ্রাফিতির বই, অভ্যুত্থানকালীন প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম পাতা সংবলিত বই, শহীদ ও আহতদের চিকিৎসা সনদ, পোস্টমর্টেম ও সুরতহাল প্রতিবেদন, অস্ত্র ও বুলেট ব্যবহারের হিসাব সংবলিত জিডি ও প্রতিবেদন, হেলিকপ্টারের ফ্লাইট শিডিউল ইত্যাদি। ৯৩টি প্রদর্শনীর মাধ্যমে উক্ত দালিলিক সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। ৩২টি বস্তু প্রদর্শনীর মাধ্যমে অসংখ্য বুলেট, পিলেট, রক্তমাখা কাপড়, ভিডিও এবং অডিও সংবলিত ডিভিডি, পেনড্রাইভ, বই ইত্যাদি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া ৮৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়। যার মধ্যে ৫৪ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দেন।
স্টেট ডিফেন্স নিয়ে সমালোচনা
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে মো. আমির হোসেনের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়েছেন তিনি। ভিডিওতে ট্রাইব্যুনাল ও আমির হোসেনের একটি কথোপকথন রয়েছে, যেখানে তাকে হাসতেও দেখা যাচ্ছিল। তা দেখে তার সমালোচনা করেন অনেকে। মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনও আসামির আইনজীবী না থাকলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে তার জন্য আইনজীবী ট্রাইব্যুনালই দিয়ে থাকেন। তাকে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলা হয়। মামলার একটি বিশেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ দাখিলের পরে তিনি পলাতক থাকলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে আত্মসমর্পণ করতে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরেও যদি আত্মসমর্পণ না করে সেই পর্যায়ে এসে অভিযুক্তের জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু আসামি পলাতক থাকলে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আসামিপক্ষে তিনি কোনও সাক্ষীও হাজির করতে পারবেন না, আপিল বিভাগেও যেতে পারবেন না।
অভিযোগ শুনানি থেকে শেষ
এই মামলায় চার্জ শুনানি শুরু হয় ১ জুলাই থেকে। অভিযোগ গঠন করা হয় ১০ জুলাই। এদিন মামলার ৩নং আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করেন। প্রসিকিউশনের ওপেনিং স্টেটমেন্ট শুরু হয় ৩ আগস্ট। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় একই দিন। প্রথম সাক্ষী (গুরুতর আহত) ছিলেন খোকন চন্দ্র বর্মণ। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর। সর্বশেষ সাক্ষী ছিলেন (তদন্ত কর্মকর্তা) মো. আলমগীর। মামলায় সাক্ষ্য দেন মোট ৫৪ জন। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর। যুক্তিতর্ক শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল সমাপনী বক্তব্য দেন গত ২৩ অক্টোবর। যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য মামলাটি অপেক্ষমাণ রাখা হয় ১৩ নভেম্বরের জন্য। এরপর মামলার রায়ের জন্য আজ ১৭ নভেম্বর দিন নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল-১।
অভিযোগের বিপরীতে সাক্ষী ও সাক্ষ্য
শেখ হাসিনার মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। প্রথম অভিযোগে, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা রাজাকারের নাতিপুতি’ সম্বোধন করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। সেই বক্তব্য সমর্থন করে ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন নেতাও উসকানিমূলক মন্তব্য করেন। যার ফলে ছাত্ররা আন্দোলনে ফেটে পড়ে। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডাররা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করে ও নির্যাতন চালায়। এর বিপরীতে সেই সংবাদ সম্মেলনের ভিডিওর মূল কপি; শেখ হাসিনার বক্তব্য সমর্থন করে ওবায়দুল কাদের এবং আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য সম্পর্কিত ভিডিও ও পত্রিকার খবর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর আওয়ামী লীগ পরিচালিত নির্যাতন ও নিপীড়নের নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন; যেসব ছাত্র দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে এবং তাদের ওপরে যে নির্যাতন পরিচালিত হয়, সেসব সাক্ষীর মৌখিক সাক্ষ্য হাজির করা হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগে তিনটি বিষয় উল্লেখ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে আসামি শেখ হাসিনা মোবাইল কথোপকথনে আন্দোলনকারীদের রাজাকার ট্যাগ দিয়ে তাদের ফাঁসি অর্থাৎ হত্যার নির্দেশ দেন। ১৮ জুলাই ২০২৪ তারিখ শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথনে আন্দোলন দমনে তিনি লেথাল উইপন অর্থাৎ মারণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেন ও ড্রোন ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার অবস্থান নির্ণয় করা এবং হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার নির্দেশনা দেন। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে জনতার ওপর দায় চাপানোর নির্দেশনাও দেন। শেখ হাসিনা ও হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে দুটি কথোপকথনে দেখা যায়, আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর বোম্বিং করা এবং তাদের তালিকা তৈরি করে আটক করে নির্যাতন এবং বিএনপি জামায়াত ও জঙ্গি ট্যাগ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর বিপরীতে সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান এনটিএমসি থেকে তদন্ত কর্মকর্তা প্রাপ্ত ভয়েস রেকর্ড ও তার ফরেনসিক রিপোর্ট এবং ট্রান্সক্রিপশন, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী প্রকাশিত ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতায় শহীদ যারা’ নামক ১০ খণ্ডের শহীদদের তালিকা, বিভিন্ন হাসপাতাল ও গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ শহীদ এবং আহত ব্যক্তিদের শরীর থেকে প্রাপ্ত বুলেট ও পিলেট, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ ও ছবি, গণমাধ্যমে ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজ ও ছবিসহ দালিলিক নানা প্রমাণ। এখানে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনগুলোও উপস্থাপন করা হয়েছে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার কথা। যেখানে সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও, পুলিশ আবু সাঈদকে হত্যার সময় ধারণকৃত এনটিভির লাইভ ভিডিও এবং এনটিভি অফিস থেকে নেওয়া উক্ত ভিডিওর মূল কপি, পাঁচটি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, যা পুলিশের নির্দেশে চারবার পরিবর্তন করা হয়, আবু সাঈদের পরিবারের সদস্য, পোস্টমর্টেম করা ডাক্তার, আবু সাঈদকে হত্যার ভিডিও ধারণকারী টিভি সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আন্দোলনের সহযোদ্ধা, প্রত্যক্ষদর্শী ও আক্রমণে অংশগ্রহণকারী পুলিশ সদস্যদের মৌখিক সাক্ষ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
চার নম্বর অভিযোগে, ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ঢাকার চাঁনখারপুল এলাকায় ছয় জনকে পুলিশ গুলি করে হত্যার ঘটনা সাক্ষ্য হিসেবে হাজির করা হয়েছে। চাঁনখারপুল এলাকায় পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি করার ভিডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত শহীদ আনাসকে গুলি করার ভিডিও, মাকে উদ্দেশ করে লেখা আনাসের চিঠি, ছাত্র-জনতার ওপর গুলির দৃশ্যের ভিডিও, আহতদের ধরাধরি করে নেওয়ার ভিডিওসহ প্রকাশিত প্রচারিত ভিডিও ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মৌখিক সাক্ষ্য।
পাঁচ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখ আশুলিয়া থানা এলাকায় পুলিশ ৬ জনকে হত্যা করে তাদের লাশ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাটি। এর বিপরীতে সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে মোবাইলে ধারণকৃত আশুলিয়া থানা পুলিশ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র জনতার ওপরে গুলিবর্ষণের ভিডিও, হত্যার পর ছয়টি লাশ একটি প্যাডেল ভ্যানে ছুড়ে মারার দৃশ্য এবং চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ভিডিওসহ আরও নানা ভিডিও ও ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের মৌখিক সাক্ষ্য।
পৃথিবীর যেকোনও আদালতে এই সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হলে একই শাস্তি হতো বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ঐতিহাসিক রায়ের পর চিফ প্রসিকিউটর তার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘পৃথিবীর যেকোনও আদালতে এই সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আজ যেসব আসামিকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই একই শাস্তি প্রাপ্ত হবে।’
