Image description

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এটিই তার বিরুদ্ধে প্রথম মামলার রায়। এ মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তাদের মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি আরেকটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বাংলাদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এসব সম্পদ জুলাই আন্দোলনে ‘শহীদ ও আহতদের ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এদিকে এ মামলায় রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনিই এই মামলার একমাত্র গ্রেপ্তারকৃত আসামি। সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। মামলাটির কার্যক্রম শুরুর ৩৯৭ দিনের মাথায় এর রায় ঘোষণা করা হলো। 

গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার পর ট্রাইব্যুনাল রায় পড়া শুরু করেন। ছয়টি অধ্যায়ে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায় ট্রাইব্যুনালে পড়া শেষ হয় প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর। পরে দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনা নিজের বিয়েবার্ষিকীর দিনেই ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুদণ্ডের রায় পেলেন। শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার সময় এই ট্রাইব্যুনালে একই আইনে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তা কার্যকর করা হয়। তাদের মধ্যে জামায়াতের আমীর, সেক্রেটারিসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা ছিলেন। ট্রাইব্যুনালে সেই সময়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আদালতের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, এই ট্রাইব্যুনাল যেন চালু থাকে। একদিন এখানেই হাসিনার বিচার হবে।

ওদিকে রায় ঘোষণার পর জুলাইযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও আহত জুলাইযোদ্ধারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে তারা সাবেক আইজিপি’র সাজা কম হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রায় ঘিরে শঙ্কা থাকলেও সারা দেশে বড় কোনো অঘটনের তথ্য পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ শাটডাউন কর্মসূচির ঘোষণা দিলেও সারা দেশে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। রাজধানীতেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাউকে দেখা যায়নি। রায়ে সরকারের তরফে সন্তোষ প্রকাশ করে দেশবাসীকে সতর্ক ও সংযত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। রায় ঘোষণার পর সরকারের তরফে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ফের দিল্লিতে চিঠি পাঠাবে সরকার। ভারত রায় ঘোষণার পর সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, রায়ের বিষয়ে তারা অবগত। 

রায় ঘোষণাকালে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘হাত, পা, নাক, চোখ, মাথার খুলি হারানো যেসব সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের বাস্তব অবস্থা দেখলে যেকোনো মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা ধরে রাখা কঠিন। ফলে এই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের যেকোনো মূল্যে বিচারের আওতায় আনা উচিত। এক্ষেত্রে ন্যায়বিচারকে ব্যাহত হতে দেয়ার সুযোগ নেই। পরে রায় ঘোষণার শুরুতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে বিভিন্ন ভিডিওতে পাওয়া শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য-প্রমাণের বিবরণ দেয়া হয়। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, সাভার, আশুলিয়া, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে যেভাবে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করা হয়েছে, সেগুলোর ভিডিও ও তথ্য-প্রমাণের বিবরণ দেয়া হয়। ঘটনার শিকার ও সাক্ষীরা কী বলেছে তার বর্ণনা আসে রায়ে। এ ছাড়া আন্দোলনের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টের বিভিন্ন অংশ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া, গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে বিভিন্নজনের সঙ্গে শেখ হাসিনার টেলিফোনে কথোপকথনগুলো পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক মাকসুদ কামালের সঙ্গে ফোনালাপ এর তথ্যও উল্লেখ করা হয় রায়ে।  

যেসব অভিযোগে সাজা হলো: এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগকে দুটি অভিযোগে ভাগ করে সাজা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম অভিযোগটি ছিল- ২০২৪ সালের ১৪ই জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা ও সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে হামলা চালায়। এছাড়া ২০২৪ সালের ১৬ই জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে ফোনে শেখ হাসিনা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বলছিলেন, রাজাকার হতে চেয়েছে ওরা, তাই ওদের ফাঁসি দিয়ে দিবো। এ সব ঘটনায় আসামিদের প্ররোচনা, উস্কানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শান্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ যা আসামিদের জ্ঞাতসারে ছিল বলে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে। এতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি প্রমাণিত হয়েছে।

তিনি বলেন, এই দু’টি অভিযোগকে একটি অভিযোগ হিসেবে কাউন্ট করে শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। তিনি আরও বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আনা সুনির্দিষ্ট ৫টি অভিযোগের মধ্যে দ্বিতীয় অভিযোগসহ মোট ৩টি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এই ৩টি অভিযোগকে একটি অভিযোগ হিসেবে কাউন্ট করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ সব অভিযোগ হলো- আন্দোলনকারীদের দমনে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া। এই নির্দেশনার কথা শেখ হাসিনা ঢাকা দক্ষিণ সিটির তৎকালীন মেয়র তাপসকে জানাচ্ছিলেন। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে কথোপকথনে হাসিনা আন্দোলনকারীদের দমনে ছত্রীসেনা নামানোসহ বিভিন্ন নির্দেশনার কথা জানাচ্ছিলেন। এছাড়া ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ছয়জন ছাত্র নিহত হন। একইদিনে আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা। পরে তাদের মধ্যে পাঁচজনের লাশ পুড়িয়ে দেয়া এবং এদের মধ্যে গুরুতর আহত একজনকে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। 

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যাপারে মিজানুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে এবং যেসব অভিযোগে সাজা দেয়া হয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগে একই সাজা দেয়া হয়েছে। শুধু শেখ হাসিনা ও ভিসি মাকসুদ কামালের কথোপকথনে আন্দোলনকারীদের ফাঁসি দেয়ার কথা বলে যে অপরাধ শেখ হাসিনা করেছিলো সেই অভিযোগটি আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আনা হয়নি।

রাজসাক্ষী চৌধুরী মামুনের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড: রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। রাজসাক্ষী হয়ে পুরোপুরি ‘সত্য উন্মোচন’- করায় চৌধুরী মামুনের সাজাও কমেছে। গতকাল রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের অপরাধও প্রমাণিত হয়েছে। তবে, আদালত ও জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। ঘটনার শিকার ও সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে যেসব বর্ণনা দিয়েছেন, তা দেখে তিনি নিজে থেকেই রাজসাক্ষী হয়ে সত্য প্রকাশের কথা জানিয়ে ছিলেন। পরে, দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ায় তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল বলেন, মামুনের ফাঁসির যোগ্য অপরাধ হলেও কম সাজা দেয়া হয় রাজসাক্ষী হয়ে তিনি সত্য উন্মোচন করেছেন।

আসামিদের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে: গতকাল প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, এই মামলার আসামিদের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। আমাদের দেশে আপিলের মেয়াদ নির্ধারিত হয় তামাদি আইন দ্বারা। এই আইনেই বলে দেয়া আছে কোন মামলায় কত দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। তিনি বলেন, তামাদি আইনের ৫ ধারায় বলা আছে, নির্ধারিত সময়ে আপিল করতে না পারলে উপযুক্ত কারণ  দেখিয়ে তা আদালতে আবেদন করতে হবে। তখন আদালত দেরি মওকুফ করে আপিল করার সুযোগ দিতে পারে। কিন্তু আইসিটি আইনের মধ্যেই বলা আছে-৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হবে। এই রায়ের সার্টিফাইড কপি বের হওয়ার পরে আপিল করতে হবে। তবে পলাতক আসামিদের ক্ষেত্রে সে সুযোগ নাই। আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এটি তারা জানেন। তাই তাদের আত্মসমর্পণ না করে আপিল করার সুযোগ নাই।
রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ক্ষুব্ধ: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন বলেন, রায়টা ভিন্নভাবে হলেও হতে পারতো, হয়নি। আমার বিপক্ষে গিয়েছে। সেজন্য আমি ক্ষুব্ধ। আমার ভেতরে কষ্ট লালন করছি। এর বাইরে আমার কিছু বলার নাই। এজন্যই কষ্ট পাচ্ছি যে, আমার আসামির সাজা হয়েছে সর্বোচ্চ সাজা। এটা কি আমাকে কষ্ট দেবে না? তিনি বলেন, ‘আমার পক্ষে এই মামলায় আপিল করার সুযোগ নাই। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার ক্লায়েন্টরা এসে ট্রাইব্যুনালে সারেন্ডার করবেন। অথবা তারা কোনোভাবে গ্রেপ্তার হবেন। এর আগ পর্যন্ত কোনো এপিলেট ডিভিশনে যাওয়ার সুযোগ নেই। আপনারাতো দেখেছেন আমাকে রায়ের কপিও ট্রাইব্যুনাল দেবে না বলেছে।

যুগান্তকারী রায়- এটর্নি জেনারেল: এই রায়কে একটি যুগান্তকারী রায় বলে মনে করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, আজকে যে রায় হয়েছে, তাতে শহীদরা ন্যায় বিচার পেয়েছে, রাষ্ট্র ন্যায় বিচার পেয়েছে, প্রসিকিউশন ন্যায় বিচার পেয়েছে। এই মামলার দু’জন আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। একজন আসামি, যিনি রাজসাক্ষী হিসেবে নিজেকে আদালতের সামনে উপস্থাপন করেছেন, সার্বিক বিবেচনায় আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। আমরা মনে করি- এ রায় শহীদদের প্রতীক, দেশের প্রতীক, এদেশের মানুষের প্রতীক, গণতন্ত্রের প্রতীক, দেশের সংবিধানের প্রতীক। এ রায় একটি যুগান্তকারী রায়। এ রায় শান্তি আনবে, এ রায় বাংলাদেশের মানুষের ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা। এ রায় আইনের শাসনের জন্য একটি বার্তা হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, পাঁচটি অভিযোগকে তিনটি গ্রাউন্ডে এনে সাজা দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনাকে একটি গ্রাউন্ডে সুপেরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিতে যাবজ্জীবন জেল, আন্টিল ন্যাচারয়াল ডেইথ দেয়া হয়েছে। সরাসরি যেটি নির্দেশনা দিয়েছেন সেখানে তাকে ডেথ পেনাল্টি দেয়া হয়েছে। আসামিরা যেদিন থেকে গ্রেপ্তার হবেন সেদিন থেকে সাজা কার্যকর হবে। রাষ্ট্র আইনিভাবে যা যা করা সম্ভব সব করবে। তিনি আরও বলেন, এই মামলায় শহীদের পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের দেশের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের সন্তোষ প্রকাশ: রায় ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, এই রায়ের প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের সমাপ্তি হয়েছে। যদিও আরও অনেকগুলো মামলা বিচারাধীন রয়েছে। শহীদ পরিবার, যাদের ক্ষতি কোনো কিছু দিয়ে পূরণ হবে না, তাদের সামনে অন্তত একটা ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছি। এ জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

তিনি আরও বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামিদের যে সাজা দেয়া হয়েছে, পৃথিবীর যেকোনো আদালতে এই সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করলে একই শাস্তি পাবেন। যে ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ এই আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে, বিশ্বের যেকোনো আদালতের স্ট্যান্ডার্ডে এই সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো উতরে যাবে এবং পৃথিবীর যেকোনো আদালতে এই সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আজ যেসব আসামিকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই একই শাস্তি প্রাপ্ত হবেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সব আন্তর্জাতিক নর্মস, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে ক্রাইমস এগেন্স হিউম্যানিটির মতো কমপ্লেক্স (মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জটিল) অপরাধের বিচার করতে সক্ষম এবং বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে সেটা করেছে। অপরাধী যতই ক্ষমতাশালী হোক, সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে যত বড় অপরাধীই হোক, তার অপরাধের জন্য তাকে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে এবং তার প্রাপ্য শাস্তি পেতে হবে। 

মামলার ৩৯৭ দিনের মাথায় রায়: পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলার কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের ১৭ই অক্টোবর। সেদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয়। ওই দিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। মামলায় প্রথমে শেখ হাসিনাই ছিলেন একমাত্র আসামি। ১৬ই মার্চ তার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ই মে এই মামলায় চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আসামি হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নাম আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। গত ১লা জুন ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এর মধ্যদিয়ে ‘মিসকেস’ আনুষ্ঠানিকভাবে মামলায় রূপ নেয়। ১০ই জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই আব্দুল্লাহ আল-মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। গত ৩রা আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। আর এর মধ্যদিয়েই মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন এ মামলায়। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত ৮ই অক্টোবর। যুক্তিতর্ক শেষ হয় ২৩শে অক্টোবর। ১৩ই নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানান, ১৭ই নভেম্বর মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।